27 December 2013

‘আ'ইশাহ: এক বিদূষী নারীর জীবন থেকে (পর্ব-৩)

লেকচার : ইসমাইল কামদার, প্রতিলিপি : জারা টি.
ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির টিউটোরিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট শাইখ ইসমাইল কামদারের ঘণ্টাব্যাপী লেকচারের প্রতিলিপি থেকে অনুদিত।

পাঠকের পড়ার সুবিধার জন্য চারটি পর্বে ভাগ করে প্রকাশ করা হবে ইনশা'আল্লাহ। তৃতীয় পর্বে থাকছে: তৃতীয় পর্বে থাকছে, 'আইশাহ (রা)-এর প্রতি অপবাদ দেওয়ার ঘটনা, সমাজে গীবাহ (গীবত) বা পরনিন্দার ভয়াবহ পরিণতি এবং নাবী ﷺ যে অদৃশ্যের জ্ঞান ('ইল্‌ম আল-গায়্‌ব) জানতেন না তার প্রমাণ।

মিথ্যা অপবাদ
‘আ’ইশাহ (রা)-এর জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা হচ্ছে হ়াদিস়-উল-ইফ্‌ক বা তাঁর উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ঘটনা। আলোচক-সমালোচক সবার মাঝেই সম্ভবত এই ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি পর্যালোচনা হয়েছে। ঘটনাটা এমন:

ইশাহ (রা) নাবী -এর সাথে একবার এক সফরে ছিলেন। ফেরার পথে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি ক্যাম্প থেকে একটু বের হয়েছিলেন। ক্যাম্পে ফেরার পথে হঠাৎ খেয়াল করলেন তিনি তাঁর গলার নেকলেস ফেলে এসেছেন। সেটা আনার জন্য আবার পেছনে ফেরত গেলেন। এদিকে তিনি যে ক্যাম্পে নেই সেটা অন্যান্যরা বুঝতে পারেনি; কারণ তিনি চারদিক-ঘেরা একটা বাহনের মধ্যে ছিলেন। তিনি আছেন—এটা ধরে নিয়ে অভিযাত্রী দল মাদীনাহ্‌র পথে ফিরতি যাত্রা শুরু করল। ইশাহ যখন ফিরলেন ততক্ষণে কাফেলা অনেক দূরে চলে গেছে। বিরান মরুভূমিতে তিনি একা পড়ে রইলেন। ভাবলেন তাকে না-পেয়ে অভিযাত্রী দল হয়তো আবার ফিরে আসবে। তাই একটা পাথরের উপর বসে বসে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। রাতের মরুভূমির এলোমেলো বাতাসে তাঁর নিক়াবটা একটু সরে গেল। ঘুমিয়ে থাকায় এর কিছুই তিনি টের পেলেন না।

এক সাহাবী মূল অভিযাত্রী দল থেকে আগেই অনেক পিছে পড়ে ছিলেন। তিনি যখন সেই একই পথ দিয়ে ঘোড়া চড়ে আসছিলেন তখন দেখলেন পাথরের উপর কেউ শুয়ে আছেন। কাছে যেয়ে চিনতে পারলেন ইনি ‘আ’ইশাহ। নিক়াববিহীন অবস্থায় ইশাহকে দেখে তিনি শুধু এটুকুই বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজি‘উন। আওয়াজ পেয়ে ইশাহ (রা) জেগে উঠলেন। সাথে সাথে মুখ ঢেকে নিলেন তিনি। কেউ কারও সাথে আর টু শব্দটি করলেন না। ঘোড়া থেকে নেমে সেই সাহাবী উম্মুল-মু’মিনীন (বিশ্বাসীদের জননী) ‘আ’ইশাহকে ঘোড়ায় ওঠালেন। আর নিজে পায়ে হেঁটে পৌঁছালেন মাদীনাহ্‌য়।

‘আ’ইশাহ ও সেই সাহাবীর মধ্যে কী অসাধারণ ধর্মানুরাগের দৃষ্টান্ত দেখছি আমরা। ইশাহও যেমন সাহাবীর সাথে কোনো কথা বলেননি, তেমনি সেই সাহাবীও তাঁর সাথে কোনো কথা বলেননি। আল্লাহভীতি তো একটা কারণ বটেই, সেই সাথে তারা জানতেন যে, নাবী -এর শত্রুরা নাবী পরিবার ও নাবীর যেকোনো ভুল ধরার জন্য মুখিয়ে আছে। কাজেই যতটা নিষ্কলুষভাবে সম্ভব সেই সাহাবী ইশাহকে মাদীনাহ্‌য় ফিরিয়ে আনলেন।

কিন্তু তাঁদের ফেরার সময় ভণ্ড-ধার্মিক আব্‌দুল্লাহ ইব্‌ন উবায় দেখে ফেলেছিলেন। ইশাহর ঘাড়ে কলঙ্কের বোঝা চাপানোর অসৎ ইচ্ছায় তিনি এই ঘটনাকে ব্যবহার করলেন। তিনি অপপ্রচার চালাতে লাগলেন যে, ইশাহ ও সেই সাহাবী অবৈধ কাজ করেছেন। 

মানুষের মুখে মুখে গুজব ছড়াতে সময় লাগল না।

এদিকে যাত্রা থেকে ফিরে ইশাহ ছিলেন অসুস্থ। তাই ঘর থেকেও আর বের হননি তিনি। ফলে বাইরে তাঁকে নিয়ে কী কানাঘুষা হচ্ছে সে ব্যাপারে কিছুই টের পেলেন না। তবে রাসূলুল্লাহ -এর আচরণে তিনি কিছুটা পরিবর্তন খেয়াল করছিলেন। আগের সেই অনুরাগ নেই। উষ্ণ আবেগ নেই।

আচরণ পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারলেন যখন জানলেন, তাকে নিয়ে চারপাশে কী রটনা চলছে। ঘটনার সত্যতা জানার জন্য তাঁর বাবা-মা’র কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। তাঁরা জানালেন রটনার ঘটনা সত্য। মেয়েকে এজন্য সান্তনা দিতে লাগলেন।

ইশাহ মনস্থির করলেন কয়েকটা দিন তিনি বাবার বাড়িতেই থাকবেন। কঠিন এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে লাগলেন।

ওদিকে রাসূলুল্লাহ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুসন্ধান শুরু করলেন। খোঁজ লাগালেন গুজবের শেকড় জানার জন্য।

আবু বাক্‌র (রা)-এর বাড়িতে এলেন একদিন। কথা বললেন সবার সাথে। পুরো ঘটনাটা নিয়ে তাঁরা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তখন ইশাহ নিজেই বলে উঠলেন, “আমি জানি আমি নির্দোষ, কিন্তু মানুষ এখন আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমার ব্যাপারটা তাই আমি আল্লাহর ওপরই ছেড়ে দিলাম। আল্লাহই আমাকে সাহায্য করবেন।” এরপরই সূরা নূরের প্রায় ১০ অথবা ২০টি আয়াত আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন। এই আয়াতগুলোতে ইশাহর সতীত্ব পরিষ্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা তাঁকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে এবং এই জঘন্য গুজব ছড়িয়েছে তাদের গন্তব্য জাহান্নাম।

আয়াতগুলো যখন অবতীর্ণ হলো, ইশাহর মা-বাবা রাসূলুল্লাহ -কে ধন্যবাদ দিতে বললেন। কিন্তু অভিমান মেশানো কণ্ঠে ‘আ’ইশাহ বললেন, ধন্যবাদ যদি দিতেই হয়, তাহলে আল্লাহকেই দেবেন।

ঘটনা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

১. পাপের সাথে সাথে পাপযুক্ত পরিবেশ থেকেও বেঁচে থাকা: পাপ কাজ থেকে যেমন বেঁচে থাকা জরুরি, তেমনি লোকে অভিযুক্ত করতে পারে এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশ থেকেও বেছে চলা জরুরি। কারণ, লোকজন যদি আপনাকে এমন কোনো কাজ করতে দেখে—যেটার ভুল ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে—তাহলে তারা সেটাকে ব্যবহার করে আপনার নামে ভুল কথা ছড়াবে।

নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করা এবং জনসম্মুখে সম্মানজনক ভাবমূর্তি রক্ষা করা দীন-য়েরই একটি অংশ।

২. নাবীপত্নীরা নিক়াব পড়তেন: এ ঘটনা থেকে আমরা আরও জানতে পারছি রাসূলুল্লাহ -এর স্ত্রীরা পরিপূর্ণ পর্দার জন্য মুখ ঢেকে রাখতেন। মুখ ঢাকা বাধ্যতামূলক নাকি উৎসাহমূলক (মুস্‌তাহাব) সেটা নিয়ে ‘আলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা উৎসাহমূলক। করতেই হবে এমন না, তবে রাসূলুল্লাহ -এর স্ত্রীরা যে করতেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই যেসব মুসলিমরা নারীদের মুখ ঢাকতে বারণ করেন, যারা বলেন এটা ইসলামে নেই—এই ঘটনা তাদের নিষেধাজ্ঞা ও দাবির বিরুদ্ধে এক অকাট্য প্রমাণ। ইশাহ (রা.) নিজ পরিবারের লোকজন ছাড়া সবার সামনেই নিক়াব পড়তেন।

৩. নাবী ‘আলিমুল-গাইব নন: রাসূলুল্লাহ অদৃশ্যের খবর জানতেন না। আল্লাহ ওয়াহির মাধ্যমে তাঁকে যতটুকু জানাতেন তিনি শুধু ততটুকুই জানতেন; এর বেশি না। অনেকে মনে করেন তিনি গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানতেন। তিনি যদি আসলেই গায়েবের খবর জানতেন তাহলে তিনি ঘটনাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন না। তাঁর আচরণে পরিবর্তন আসত না। সত্যটা জানার জন্য খোঁজ লাগাতেন না। এবং ওয়াহির জন্যও অপেক্ষা করতেন না। গায়েব জানলে তিনি আগেই জেনে ফেলতেন যে, ইশাহ নিষ্পাপ। অদৃশ্যের খবর তিনি ততটুকুই জানতেন, যতটুকু আল্লাহ তাঁকে জানাতেন।

জঘন্যতম দুই পাপ
অপবাদ দেওয়া এবং পরনিন্দা করা—এ দুটো জঘন্যতম পাপকাজ। সমাজে খুব বাজে প্রভাব ফেলে এগুলো। একটি হ়াদীস়ে তো এমনকি এটাও বলা হয়েছে যে, পরনিন্দা করা ব্যাভিচার করার চেয়েও খারাপ। এটা যে কত খারাপ সেটা তো আমরা উপরের ঘটনা থেকেই বুঝতে পারছি। ভালো মানুষের জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে গীবাহ (গিবত) বা পরনিন্দা। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান পুরুষ কিংবা নারীকে নিয়ে সমাজের লোকেরা যখন বাজে কথা বলা, তাদের নিয়ে গুজব ছড়ায় এটা তখন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খুব নাকাল করে দেয়। বেঁচে থাকাটাই দায় তখন। ইমাম বুখারী (রাহ়িমাহুল্লাহ) তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।

ইমাম বুখারীর জীবনে অপবাদের করুণ পরিণতি
জীবনের শেষ বয়সে, কিছু লোক হিংসাবশত তাঁর কিছু কথার ভুল ব্যাখ্যা করতে শুরু করেঐ লোকগুলো গুজব ছড়ায় যে, ইমাম বুখারীর আক়ীদাহ ঠিক নেই। গুজবটা ধীরে ধীরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লোকে তখন আর তাঁর কথা শুনতে চাইল না। অবশেষে আর সহ্য করতে না-পেরে ইমাম বুখারী আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, “ও আল্লাহ, আপনার দুনিয়া অনেক প্রশস্ত হলেও আমার জন্য এটা আজ সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যান।” এর একমাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।

কেন তাঁর এই নিদারুণ পরিণতি? অধিকাংশ ‘আলিমরা বলেছেন তাঁর নামে যেসব নিন্দা, গুজব, রটনা আর ভিত্তিহীন অপবাদ ছড়ানো হয়েছিল, এগুলো তাঁর জীবনকে বিষময় করে তুলেছিল। এগুলোই তাঁকে এমন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এসব নিন্দা, গুজব, অপবাদ যদি ইশাহ আর ইমাম বুখারীর মতো ভালো ভালো মানুষদের এভাবে আক্রান্ত করতে পারে তাহলে আপনি আমি, আপনার প্রতিবেশী, পরিবারের সদস্য কোন ছাড়? কাজেই প্রতিটি বিশ্বাসী মুসলিমদের জন্য এই ঘটনা একটা বড় সতর্কবার্তা। আপনার জিহ্বাকে সংবরণ করুন। কী বলছেন সে ব্যাপারে সাবধান।

রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, “আল্লাহ ও শেষ দিবসে যারা বিশ্বাস করে, তারা যেন ভালো কথা বলে নয় চুপ থাকে।” এটাই বিশ্বাসী মুসলিমদের চরিত্র। আপনি যা বলছেন, সেটা যদি ভালো কিংবা কল্যাণকর কিছু না হয়, তাহলে বলার দরকার নেই। অন্যের ব্যাপারে নিন্দা করার প্রয়োজন নেই।

অন্য একটি হ়াদীস়ে রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, “যেসব জিনিসের সাথে আপনার সম্পর্ক নেই সেগুলো নিয়ে না-ভাবা নিখাদ ঈমানের বৈশিষ্ট্য।” অন্যের জীবন নিয়ে নাক গলাবেন না। কে কী পাপ করছে, নতুন কোন গুজব ছড়ালো, কে কার নিন্দা করছে এগুলো থেকে দূরে থাকুন। এগুলো খারাপ কাজ। সমাজকে ধ্বংস করে দেয় এগুলো। ইশাহর এই ঘটনা থেকে এগুলোই শিখলাম আমরা।


অন্যান্য বক্তারা ইশাহ (রা)-এর এই ঘটনা থেকে হয়তো আরও অনেক হিতোপদেশ বের করতে পারবেন। অনেক লেখকেরা হয়তো বের করেছেনও। আসলে নাবী-রাসূল, সাহাবা, অতীতের বিজ্ঞ লোকদের ঘটনা এমনই। একটি ঘটনা থেকে বের করা যায় অসংখ্য হিতোপদেশ।

(চলবে...) চতুর্থ ও শেষপর্বে থাকছে 'আ'ইশাহ (রা.)-এর জীবনের আরও কিছু চমৎকার ও বৈচিত্রময় কাহিনি।

No comments:

Post a Comment

আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।