প্রথম জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — আল্লাহর বিধিবিধান মানার গুরুত্ব
সূরাহ আল-বাকারাহর প্রায় অর্ধেক শেষ হয়েছে প্রথম জুযে।
আল-কুর'আনের সবচাইতে বড় সূরাহ হচ্ছে আল-বাকারাহ। এই সূরাহর মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে
ইসলামিক আইন ও এগুলো মেনে চলার গুরুত্ব।
মাদীনাহয় ইসলামিক রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তখন এই
সূরাহ অবতীর্ণ হয়। নবগঠিত এই ইসলামিক রাষ্ট্রের সফলতার জন্য আইনগুলো ছিল খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি আজকে পুনরায় ইসলামকে উজ্জীবিত করতে চাই, তাহলে
আমাদের প্রথম কাজ হবে আল্লাহর বিধিবিধানগুলোকে আমাদের জীবনে অগ্রাধিকার দেওয়া।
বিধিবিধানগুলো মূলত বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া হলেও, ক়ুর'আনের
প্রথম আদেশটি গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করেই দেওয়া হয়েছে: "হে মানবজাতি, তোমাদের
প্রভুর 'ইবাদাত করো,"
(২:২১)। ক়ুর'আনে প্রথম যে-আদেশ দেওয়া হয়েছে
সেটা হচ্ছে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস। এর প্রতিই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া
হয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে তাওহীদই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাওয়া—একে
অস্বীকার করার জো নেই।
আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধানগুলো মেনে চলা কেন গুরুত্বপূর্ণ এটা
বোঝানোর জন্য প্রথম জুযে অনেকে কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহর অবাধ্যতা
করেছে এসব কাহিনিতে তাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম কাহিনিটা হচ্ছে আদাম ও
শাইতানের কাহিনি। আদামকে সিজদাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল শাইতান। আল্লাহর প্রতি
অবাধ্যতার প্রথম নজির ছিল এটাই।
প্রথম জুযের অধিকাংশ জায়গাতেই উঠে এসেছে বানি ইসরাঈলদের
কাহিনি। কত শতবার তারা যে বিভিন্নভাবে আল্লাহর বিধিবিধানকে অমান্য করেছে, এবং এর
ফলে তাদের যে ফল ভোগ করতে হয়েছে সেগুলোই তুলে ধরা হয়েছে এসব কাহিনিতে। বর্তমান
সময়ের মুসলিমরা যেভাবে বিভিন্ন উপায়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করে চলেছে তার সাথে বানি
ইসরাঈলিদের এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
নাবি ইব্রাহিম (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) ও তাঁর
ন্যায়নিষ্ঠ বংশধরদের অনুসরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেষ হয়েছে প্রথম জুযটি। আল্লাহর
কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়া ও তাঁর আইনের প্রতি বাধ্যানুগত থাকার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত
ছিলেন নাবি ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরেরা।
দ্বিতীয় জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — ইসলামের বিধিবিধান
আল-কুর’আনের দ্বিতীয় জুয জুড়েও রয়েছে সূরাহ আল-বাকারাহ।
কাজেই প্রথম জুযের বিষয়বস্তুর সাথে বেশ মিল রয়েছে দ্বিতীয় জুযের। আমরা দেখেছি
প্রথম জুযে আল্লাহর বিধিবিধান মানার গুরুত্ব এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাহিনি
উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই জুযে দেওয়া হয়েছে সেসব আইনগুলোর বিস্তারিত বিবরণ।
গোটা ক়ুর’আনের এই জুযটিতেই সম্ভবত ফিকহি আদেশ-নিষেধ
নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে। সলাত ও ধৈর্য (২:১৫৩) থেকে শুরু করে ইসলামিক
আইনের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই আলোচনায় এসেছে এই জুযে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. কেবল হালাল খাওয়ার নির্দেশনা (২:১৬৮)
২. সলাতের কিবলাহ সংক্রান্ত আলোচনা (২:১৪২-১৪৫)
৩. অপরাধ সম্পর্কিত ইসলামিক আইন ও এর গুরুত্ব
(২:১৭৮-১৭৯)
৪. রমাদান মাস ও সিয়াম সংক্রান্ত বিধিবিধান (২:১৮৩-১৮৬)
৫. জিহাদ ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধিবিধান (২:১৯০-১৯৫,
২১৬-২১৮)
৬. হাজ্জ ও ‘উমরাহর বিধিবিধান (২:১৯৬-২০০)
৭. কাদেরকে দান করা যাবে (২:২১৫)
৮. বিয়ে, সন্তানকে দুগ্ধপান, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও বিপত্নীক
সংক্রান্ত বিধিবিধান (২:২২১-২৪২)
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ ও ফিকহের
প্রধান প্রধান সব বিষয় এই জুযের মূল আলোচ্য বিষয় হলেও, জুযটি শেষ হয়েছে আল্লাহর
বিধিবিধান মানার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আরও একটি কাহিনির বর্ণনা দিয়ে।
বানি ইসরাইলদের উপর যখন রাজা তালূতকে নিযুক্ত করা হয়,
তখন তিনি তাদের পক্ষ থেকে প্রচুর বিদ্রোহের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তাঁকে গোলিয়াথের
বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। এই যুদ্ধে তাঁর অধীনে লোকসংখ্যা ছিল অল্পই। তবে
এঁদের মধ্যে ছিলেন নাবি দাঊদ (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। এই অল্প সংখ্যক বাহিনী
নিয়েই তাঁরা বিজয় অর্জন করে নিয়েছিলেন।
এই কাহিনি থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হচ্ছে, আল্লাহর বিধিবিধান
মেনে চলা মানুষের সংখ্যা যদি অল্পও হয়, তবুও শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাদের বিজয়
দেবেন। কাজেই পৃথিবীর বুকে ইসলাম মেনে চলা লোকের সংখ্যা যত কমই হোক না কেন, আমরা
যেন সত্যের ব্যাপারে সবসময় অবিচল থাকি।
“অধিকাংশ সময়ে এমনটাই হয়েছে যে সংখ্যায় অল্প একটা দল, আল্লাহর
ইচ্ছায় কত বড় একটা বাহিনীকে পরাস্ত করেছে। আল্লাহ তাদের সাথেই আছেন যারা ধৈর্য ধরে
রাখে।” (২:২৪৯)
তৃতীয় জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — মাদীনাহ রাজনীতি
সূরাহ আল-বাকারাহ-এর উপসংহার টেনে শুরু হয়েছে তৃতীয়
জুযটি। এখানেই রয়েছে সেই বিখ্যাত আয়াত: আয়াতুল-কুরসী (২:২৫৫)। এই আয়াতে রয়েছে
আল্লাহর মাহাত্মের বর্ণনা। বিষয়বস্তুর ব্যাপকতার কারণে শুধু এই আয়াতটিই ভিন্ন এক আলোচনার
দাবি রাখে।
সূরাহ আল-বাকারাহ্র অন্যান্য আয়াতে ফিকহি বিষয় আলোচনা
করা হয়েছে। এসব ফিকহি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ব্যবসা, দান, ঋণ, ওয়াসিয়্যাত ও অন্যান্য
আর্থিক বিষয়। বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে সুদ (ইন্টারেস্ট) নিষিদ্ধকরণের উপর। প্রকৃত
বিশ্বাস ও ন্যায়নিষ্ঠ থাকার গুরুত্বের উপর আলোচনা করে শেষ হয়েছে এই সূরাটি।
সূরাটির শেষ আয়াতে ফিক়্হের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
মৌলিক নীতির উল্লেখ আছে। “আল্লাহ কোনো মানুষের উপর তার সাধ্যের বাইরে কোনো বোঝা
চাপিয়ে দেন না।” (২:২৮৬) ইসলামের কোনো বিধানই যে মানুষের সামর্থ্যের বাইরে নয়, এই
আয়তটি তারই এক স্পষ্ট প্রমাণ। কোনো বিধান যদি কোনো ব্যক্তির সামর্থ্যের বাইরে চলে
যায়, সেক্ষেত্রে তার জন্য শিথিল করার ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন এই সূরাহ্র মধ্যেই
উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অসুস্থতার কারণে রমাদ়ানের অত্যাবশ্যকীয় সিয়াম
পালন করতে না পারেন, তাহলে রমাদানের পরেও তিনি সেগুলো রাখতে পারবেন।
আল-কুর’আনের দ্বিতীয় সূরাহ হচ্ছে আলি-‘ইমরান। প্রথম
দেখায় মনে হতে পারে যে, সূরাটিতে কোনো একক নির্দিষ্ট বিষয় আলোচনা করা হয়নি।
সূরাটিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে, উহুদ যুদ্ধ থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা বলা
আছে, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের প্রতি এক বার্তা দেওয়া হয়েছে এবং সাবধান করা হয়েছে
ভণ্ডদের।
তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে যখন দেখা হয়, তখন এর
বিষয়বস্তু স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হিজরি তৃতীয় সনে মুসলিম উম্মাহ নতুন ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন
করছিল। সেইসাথে শক্তি সংগঠিত করছিল।
সেই সনে নবগঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রকে যেসব রাজনৈতিক বিষয়
সামলাতে হচ্ছিল সেগুলো হচ্ছে উহুদ যুদ্ধ ও এর ফলাফল, ইহুদি ও ভণ্ড মুসলিমদের
চক্রান্ত এবং মাদীনায় আগমনকারী খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলের প্রতি দা‘ওয়াহ। এ সবগুলো
বিষয়ই মাদীনায় একটা রাজনৈতিক আবহ তৈরি করছিল, আর এটাই এই সূরার মূল আলোচ্য বিষয়।
ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে তুলে ধরার মাধ্যমে সূরাটি
শুরু:
১. আল্লাহর একত্ব (৩:২, ৫-৬)
২. আল-কুর’আনের গুরুত্ব (৩:৩-৪, ৭)
৩. সুন্নাহ/হাদীসের গুরুত্ব (৩:৩১)
৪. আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম (৩:১৯)
শেষ পয়েন্টটি তখনকার সময়ের জন্য যেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল,
বর্তমান সময়ের জন্যও তেমনি।
মাদীনা শহরে নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকের বসবাস ছিল।
কিন্তু আল্লাহ তাদের সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে, পরকালে পরিত্রাণের জন্য একমাত্র উপায়
হচ্ছে তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। এই আয়াতটি বর্তমান সময়ের জন্য আরও বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ভ্রষ্ট মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক আধুনিক মুসলিমরা মনে
করেন সব ধর্মই সমান।
তৃতীয় জুযের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মারইয়াম,
যাকারিয়া ও ‘ঈসা (তাঁদের সবার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)-এর কাহিনি। জুযটির মূল
আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক স্পষ্ট। মাদীনায় আগত খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল
যেহেতু ইসলাম জানতে এসেছিলেন, কাজেই তাদের ধর্মের কেন্দ্রীয় এসব চরিত্রের ব্যাপারে
সত্য ঘটনা জানানোটা খুব প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমান সময়ের মুসিমদের জন্যও এসব ঘটনা
থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কাহিনিগুলো গভীর চিন্তাভাবনা ও অধ্যয়নের দাবি
রাখে।
জুযের শেষ অংশে আল্লাহর একত্ব প্রমাণে খ্রিষ্টানদের
উদ্দেশ্যে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। যিশু যে (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত
হোক) রক্ত-মাংসের মানুষ ও নাবি ছিলেন সে ব্যাপারেও যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
ইহুদিদের উদ্দেশ্যেও বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, কারণে তুচ্ছ কারণে তারা
ইসলামকে অস্বীকার করে আসছিল। ইনশা’আল্লাহ পরবর্তী জুযের আলোচনায় সূরাটির বাকি
অংশের বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করা হবে।
—ইসমাইল কামদার, হেড টিউটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি
No comments:
Post a Comment
আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।