চতুর্থ জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — মাদীনাহ রাজনীতি
চতুর্থ জুয জুড়েও রয়েছে সূরাহ আলি-ইমরান। কাজেই তৃতীয়
জুযের বিষয়বস্তুর সাথে এই জুযের বিষয়বস্তুরও বেশ মিল রয়েছে। তবে এই জুযে বিশেষ
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য সামাজিক বাধ্যবাধকতাগুলো পালন করার উপর।
এই জুযের প্রথম আয়াতটিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ: “যতক্ষণ না
তোমরা তোমাদের পছন্দের জিনিস থেকে ব্যয় করবে ততক্ষণ তোমরা পুণ্যের নাগাল পাবে না।
আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করো আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন।” (৩:৯২)
এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যা কিছু উচ্ছিষ্ট সেটা থেকে
ব্যয় করা দান নয়। বরং আমরা যা পছন্দ করি সেটা থেকে ব্যয় করাই প্রকৃত দান। এ ধরনের
দানই মানুষের হৃদয়কে একীভূত করে, গরিবদের অবস্থার উন্নতি ঘটায় এবং সমাজকে বদলে
দেয়। নবগঠিত মুসলিম সম্রাজ্যের জন্য এ ধরনের দান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সাহাবিরা
নিজেদের জন্য যা পছন্দ করতেন, সেখান থেকেই দান করতেন মাদীনায় হিজরাতকারী, দরিদ্র ও
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের। আর এর ফলেই গড়ে ওঠে শক্তিশালী এক মুসলিম সম্প্রদায়।
চতুর্থ জুযের শুরুতেই অন্যতম যে গুরুত্বপূর্ণ টপিকের
আলোচনা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে একতা। মুহাজিরূন ও আনসারদের মধ্যে যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব
ছিল, সেটা না থাকলে মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হতো না। আমাদের সময়েও যদি আমরা
ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাই তাহলে বিশ্বাসীদের মধ্যে একতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক
বিষয়।
নিচের আয়াতটা খেয়াল করুন:
“সবাই আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে; তারপর তিনি
তোমাদের হৃদয়গুলোকে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহের বদৌলতে ভাই ভাই হয়ে
গিয়েছিলে। তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে অবস্থান করছিলে, তিনি তোমাদের সেখান
থেকে উদ্ধার করেছেন। এভাবেই আল্লাহর তাঁর নিদর্শনগুলোকে তোমাদের কাছে পরিষ্কার
করেন, যাতে তোমরা পাও সঠিক পথের দিশা।” (৩:১০৩)
এই জুযের কিছু কিছু আয়াতে ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াহ দেওয়ার
গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। যেমন: ১০৪ ও ১১০ নং আয়াত। ইসলামিক রাষ্ট্রের ভিত্তি
হচ্ছে দা‘ওয়াহ। কেননা দা‘ওয়াহ ছাড়া কেউ মুহাজিরীন কিংবা আনসার হতো না। মুস‘আব ইব্ন
উমাইর যদি মাদীনাতে দা‘ওয়াহ না দিতেন তাহলে হয়তো মুসলিমদের পক্ষে সেখানে হিজরাত
করাও সম্ভব হতো না। কাজেই একটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সফলতার সাথে দা‘ওয়াহ সরাসরি
জড়িত।
জুযের অন্যান্য আয়াতগুলোতে অবিশ্বাসীদের সাথে কীভাবে সম্পর্ক
রক্ষা করতে হবে সে ব্যাপারে বলা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,
যারা স্পষ্টভাবে ইসলামের বিরোধীতা করে তাদের সাথে যেন আমরা কোনো বন্ধুত্বের
সম্পর্ক স্থাপন না করি। আমাদের বিশ্বাস কিংবা জীবনব্যবস্থায় যেন তাদের অনুককরণ না
করি। ১৪০০ বছর আগে এই মূলনীতি যেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, আজও তেমনি।
জুযের শেষ ভাগের আয়াতগুলোতে উহুদ যুদ্ধের ফলাফল ও এ থেকে
প্রাপ্ত শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। উহুদ যুদ্ধ থেকে আমরা শিখি, রাসূলুল্লাহ
(তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক)-কে মানার গুরুত্ব, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা থাকার
ভয়াবহ দিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে নাবিও (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত
হোক) ছিলেন রক্তে-মাংসের মানুষ।
যখন এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, যুদ্ধে নাবি মারা গিয়েছেন
তখন অনেকে সাহাবিই হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না যে কী করবেন।
অনেকে তো যুদ্ধ করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর তখনই অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আয়াত
অবতীর্ণ হয়, যে আয়াতটি বহু বছর পর নাবি (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) যখন মারা যান
তখন আবু বাক্র পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। আয়াতটি হচ্ছে:
“মুহাম্মাদ তো একজন বার্তাবাহক ভিন্ন অন্য কিছু নন। তাঁর
আগেও বহু বার্তাবাহক চলে গেছেন। যদি তিনি মারা যান, কিংবা তাঁকে হত্যা করা হয়
তাহলে কি তোমরা পালিয়ে যাবে?” (৩:১৪৪)
কথা খুবই স্পষ্ট। আমাদের আনুগত্য ইসলামের প্রতি। নেতারা
জন্মান, নেতারা মারা যান। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত রাখতে হবে ইসলামের
পুনর্জাগরণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা।
পঞ্চম জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — সমাজ ও পারিবারিক জীবন
সূরা আন-নিসা যদিও শুরু হয়েছে চতুর্থ জুযে, আমি এই
সূরাটিকে পঞ্চম জুযের অধীনে একবারে আলোচনা করব। কারণ পুরো সূরাটির মূল আলোচ্য বিষয়
একই। সূরাটির নাম দেখে অনেকেই মনে করেন যে এখানে হয়তো শুধু নারীদের নিয়েই আলোচনা
করা হয়েছে। আর তাই তারা যখন সূরাটিতে উত্তরাধিকারি আইন, ভণ্ড মুসলিমদের কীভাবে
সামলাতে হবে, শির্কের ভয়াবহতা এবং খ্রিষ্টান ও ইহুদি সংক্রান্ত আলোচনা দেখেন তখন
দ্বন্দ্বে পড়ে যান।
আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরাগুলোর আলোচ্য বিষয়বস্তু এর
নামের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ‘আলিমগণ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সূরাগুলোর নামকরণ করেছেন।
নামকরণের জন্য তারা হয়তো সূরাতে এসেছে এমন অনন্য কোনো শব্দ বেছে নিয়েছেন, বা যে শব্দটি সেই সূরাতে বারবার এসেছে সেটাকেই
ব্যবহার করেছেন। তাই, সূরা আল-বাক়ারাহ্র মূল আলোচনা যেমন গরু নিয়ে নয়, তেমনি
সূরা আন-নিসার মূল আলোচনাও নারীদের নিয়ে নয়।
এই সূরাটিও মাদানি সূরা। আর তাই মাদীনার ইসলামিক
রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোই এ সূরার মূল আলোচ্য বিষয়। তবে এক্ষেত্রে
মাদীনার সামাজিক জীবনকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি মুসলিম সমাজের প্রতিটা
দিক এ সূরায় আলোচিত হয়েছে:
১. ইয়াতিম (৪:২-৩, ৬, ১২৮)
২. বিয়ে (৪:৩-৪, ১৯-২৫, ৩২-৩৫, ১২৭-১৩০)
৩. উত্তরাধিকার (৪:১১-১৪, ১৭৬)
৪. বহুবিবাহ (৪:৩, ১২৯)
৫. ইহুদি ও খ্রিষ্টান (৪:৪৬-৫৬, ১৫৩-১৭৪)
৬. ভণ্ড (৪:৮৮-৯০, ১৪২-১৪৬)
৭. সশস্ত্র যুদ্ধ (৪:৭১-৭৮)
৮. শান্তি ও ন্যায়বিচার (৪:৯২-৯৪, ১৩৫)
৯. নষ্ট কোনো সমাজ থেকে ভালো সমাজে অভিবাসন (৪:৯৭-১০০)
ইসলামের অধিকাংশ আইনগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়
হাদীসে। তবে উত্তরাধিকারের বিধানের ক্ষেত্রে আল্লাহ এখানেই বিস্তারিতভাবে বলে
দিয়েছেন। এবং যারা এগুলোকে অস্বীকার করবে তাদেরকে জাহান্নামের কথা মনে করিয়ে দিয়ে
সতর্ক করে দিয়েছেন। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সম্পদের ভাগ-বাটোয়ার
সঠিকভাবে না হওয়াতেই সমাজে ও পরিবারে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
মুসলিমরা যদি আল্লাহর
বিচার মেনে নেয়, তিনি যেভাবে ভাগ করতে বলেছেন সেভাবে করে, তাহলে এ ধরনের অনেক
সামাজিক বিশৃঙ্খলাই এড়ানো সম্ভব।
পারিবারিক বন্ধনের প্রতিও এ সূরাতে বিশেষ জোর দেওয়া
হয়েছে। সেইসাথে পরিবারের নেতা হিসেবে পুরুষদের অবস্থান এবং দায়িত্বশীলভাবে তারা
যেন এই দায়িত্ব পালন করে—এ ব্যাপারগুলোও উঠে এসেছে। আধুনিক সময়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে
তর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। আর যার ফলে সমাজে ব্যর্থ বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদের উচ্চ হার,
বিয়ে-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক ও সামাজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। একটা
সমাজ সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য পারিবারিক স্থিতি খুবই জরুরি। আর এর জন্য প্রয়োজন
আল্লাহর দেওয়া বিধান মেনে চলা। এগুলো না-মানার ফলেই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিনই
পরিবারগুলোতে কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই আছে।
পরিবারের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় হচ্ছে বহুবিবাহ। এই
সূরাতে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে
পারবে। তবে শর্ত হচ্ছে সেই পুরুষকে অবশ্যই দায়িত্ববান হতে হবে, এবং স্ত্রীদের সাথে
ন্যায়ানুগ আচরণ করতে হবে। আধুনিক সমাজের মধ্যে ইসলামকে ঠাই দিতে যেয়ে
আধুনিকতাবাদীরা এই আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এরা বুঝতে পারছেন না যে,
তারা যে সংস্কৃতির অনুকরণ করতে চাচ্ছেন সেটা কীভাবে চলছে। এসব সমাজে ছড়িয়ে আছে
সীমাহীন বহুবিবাহ। এসব ক্ষেত্রে পুরুষদেরকে কোনো দায়িত্বও নিতে হয় না। পরকীয়া ও
বিবাহ-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক এসব সমাজের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ইতিহাস সাক্ষী কুর’আনের দেওয়া বিধান অনুযায়ী যে-সমাজই
বহুবিবাহ চর্চা করেছে সে সমাজে সামাজিক সমস্যা অনেক কম। এটা বাস্তব সত্য যে, সমাজে
অনেক বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী ও পুণ্যবতী কুমারী নারীরা রয়েছেন যারা হয়তো
পুণ্যবান স্বামী পাচ্ছেন না। আবার প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষেরা বহুগামী।
দায়িত্বপূর্ণভাবে একটা সমাজে যখন বহুবিবাহ চর্চা করা হয় সেই সমাজে অনাচারের হার
অনেক কম হয়।
সূরাটিতে ইয়াতিমদের প্রতিও বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রতি জোর
দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সমাজেরই একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ইয়াতিমেরা। সমাজ যখন এদের
অবজ্ঞা করে, তখন নিজেদের জীবিকা ও বেঁচে থাকার তাগিদে এরা অন্যায় পথ বেছে নেয়।
ইয়াতিমদের যত্ন নেওয়া অনেক ভালো একটা কাজ। নিজের সন্তান মনে করে ইয়াতিমদের
লালনপালনের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতার দ্বার উন্মোচন করা হয়। আর এর ফলে
গোটা সমাজই লাভবান হয়।
আমি বিশ্বাস করি, সূরা
আন-নিসাতে যেসব মূলনীতি দেওয়া হয়েছে, কোনো সমাজ যদি সেগুলোর উপর ভিত্তি করে চলে,
তাহলে সেই সমাজ হবে সেরা সমাজ; পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে স্থিতিশীল সমাজ।
ষষ্ঠ জুয (পারা)-এর বিষয়বস্তু — নির্ভুল শারীআহ
জুযগুলো নিয়ে আলোচনার এ পর্যায়ে এসে একটা বিষয় জানানো
জরুরি মনে করছি। আল-কুর’আনকে ত্রিশটি জুযে ভাগ করা কোনো ঐশী নির্দেশনা নয়। মাসে
একবার সম্পূর্ণ কুরআন সহজে শেষ করার উদ্দেশ্যে ‘আলিমগণ এই ভাগগুলো করেছেন। তবে
সূরা অনুযায়ী ভাগ করার নির্দেশনাটি আল্লাহই দিয়েছেন। কাজেই কুর’আনে আলোচিত
বিষয়বস্তু মূলত সূরা ভেদে এক রকম; জুযভেদে নয়। যেহেতু পরবর্তী সূরাগুলো কলেবরে
ছোট, সেহেতু প্রয়োজনবোধে আমরা প্রতিটি সূরার বিষয়বস্তু নিয়ে আলাদা আলোচনা করব।
ষষ্ঠ জুযের শুরু হয়েছে সূরা আন-নিসার শেষ কিছু আয়াত
দিয়ে। এই সূরার বিষয়বস্ত আমরা আগের পোস্টেই আলোচনা করেছি। জুযটির বাকি অংশে রয়েছে
সূরা আল-মা’ইদা—খাবার টেবিল।
মাদানি যুগের শেষ ভাগে যেসব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, তার
মধ্যে এটি একটি। ফলে, নাবুওয়াতের শেষভাগে যেসব বিধিবিধান অবতীর্ণের প্রয়োজন ছিল
সেগুলোই এসেছে এই সূরাতে। সূরাটির মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শারীআহর গুরুত্ব এবং
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগ। এখানে একদিকে যেমন শারীআহ আইন ও নিষেধাজ্ঞার
বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে শারীআহ অনুসরণের গুরুত্ব এবং অনুসরণ
না করলে কঠোর হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে কেউ যদি শারীআহকে অস্বীকার করে, তাহলে
সে কুফ্রে লিপ্ত হলো।
শারীআহ শব্দটাও ব্যাখ্যা করা জরুরি। কারণ, অনেকেই শারীআহ
দ্বারা বোঝেন শুধু ফৌজদারি আইনকে। এই সূরা ও অন্যান্য সূরাতে যেসব ফৌজদারি আইন
পাওয়া যায় সেগুলোকে আসলে বলা হয় হুদূদ। এটা শারীআহ্রই একটা অংশ। তবে শারীআহ আরও
ব্যপক একটি পরিভাষা। ‘শারীআহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পন্থা। যেসব মূলনীতি, বিধিবিধান ও
ভিত্তির উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত তার সবকিছুকেই সামগ্রিকভাবে বলা হয় শারীআহ। ফিক্হ
থেকে শারীআহ আলাদা। কারণ শারীআহ আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, এবং এর ব্যাপারে
সবাই একমত। অন্যদিকে ফিক্হ হচ্ছে ব্যক্তিগত অনুধাবন, আর তাই এতে রয়েছে
মতপার্থক্য।
এই সূরায় যেসব শারী‘ঈ বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে
রয়েছে:
১. হালাল ও হারাম খাবার (৫:১-৫)
২. ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে সে
সংক্রান্ত বিধিবিধান (৫:৫, ৫১, ৫৭)
৩. ইহরাম অবস্থায় থাকাকালীন বিধান (৫:৯৪-৯৭)
৪. সামুদ্রিক খাবার খাওয়ার অনুমোদন (৫:৯৬)
৫. সলাত ও উদূ সংক্রান্ত বিধান (৫:৬)
৬. চুরির জন্য আইন (৫:৩৮-৩৯)
৭. জুয়া ও মদপানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা (৫:৯০-৯১)
সূরাটি শুরু বলিষ্ঠ এক আদেশ দিয়ে: “হে বিশ্বাসীরা, পূরণ
করো তোমাদের অঙ্গীকার!” (৫:১)। এই অঙ্গীকার হচ্ছে মুসলিম হিসেবে আল্লাহর বিধান
মানার অঙ্গীকার। প্রথম আয়াতের মাধ্যমেই আল্লাহর আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে,
এগুলো আল্লাহর বিধান। বিশ্বাসী মুসলিম হিসেবে এগুলোর সমর্থন এবং নিজের সাধ্য
অনুযায়ী পালন করতে আমরা দায়িত্ববদ্ধ।
সূরার শুরুতেই শারীআহ্র নির্ভুল প্রকৃতি তুলে ধরে বলা
হয়েছে: “আজ আমি পূর্ণ করলাম তোমাদের জীবন ব্যবস্থা, পূর্ণ করলাম তোমাদের প্রতি
আমার অনুগ্রহকে। আর জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আল-ইসলামকে তোমাদের জন্য নির্ধারিত
করলাম।” এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম এক নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম, এবং এখানে
নতুন কিছু যোগ করলে সেটা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। আমাদের এটাও ভাবনাচিন্তা করা উচিত
যে, শারীআহ যেহেতু নিখুঁত, কাজেই এর অনুসরণে কল্যাণ বৈ আর কিছু নেই।
নাবি মূসার (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) সাথে ইসরায়েলের
বংশধরদের যখন জিহাদে যেতে বলা হয়েছিল, তখন তারা যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এই
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণও রয়েছে এখানে। জিহাদে না যাওয়ায় তাদের অপদস্থ করা হয়েছিল।
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা হচ্ছে, বিশ্বাসীরা যখন শারীআহ মানকে অস্বীকৃতি জানাবে, আল্লাহ
তখন তাদের অপদস্থ করবেন। কাজেই বর্তমানের সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র
উপায় হচ্ছে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে শারীআহ্র চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
শারীআহকে অস্বীকার করা এক ধরনের কুফ্র। এই সূরার অনেক
আয়াতেই তার ইঙ্গিত আছে। সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ৪৪নং আয়াতে: “যারা আল্লাহর
নাযিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না তারাই অবিশ্বাসী।” (৫:৪৪) তবে অধিকাংশ
মুসলিমকে কাফির সাব্যস্ত করার ছুতা হিসেবে সমসাময়িক চরমপন্থীরা এই আয়াতের ভুল
ব্যাখ্যা করেছেন। এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যার রয়েছে মারাত্মক পরিণতি। এগুলো পরিহার করতে
হবে। তবে যাই হোক, আয়াতের অর্থ স্পষ্ট: যদি তোমরা সত্যিই বিশ্বাস করো, তাহলে তোমরা
আল্লাহর আইনকে অস্বীকার করবে না।
৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, আমাদেরকে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন
নেই। আমরা যদি শারীআহ না মানি, তিনি এমন একদল সত্যিকার বিশ্বাসীদের দিয়ে আমাদের
বদলে দেবেন যারা শারীআহ অনুসরণ করবে। এই মানুষগুলো বিশ্বাসীদের প্রতি হবে ভদ্র,
অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংগ্রাম করে
এবং নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করে না।
শেষ পয়েন্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা পরিবর্তনকে ভয়
পায়, সমাজ যেভাবে চলছে সেভাবেই চালাতে চায়, প্রকৃত ইসলামকে পুনরুদ্ধার করার যেকোনো
প্রচেষ্টাকেই তারা নিন্দা করবে। হেয় করবে। কাজেই আমরা যদি ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত
করতে চাই, তাহলে এসব নিন্দাকে ঝেড়ে ফলে আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। নজর দিতে হবে
স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার দিকে।
—ইসমাইল কামদার, হেড টিউটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি
No comments:
Post a Comment
আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।