21 March 2016

কীভাবে নিজের অনুবাদকে সাবলীল করবেন

আজকে সকালের দিকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানে জিজ্ঞেস করেছিলাম অনুবাদ করতে যেয়ে আমরা কেন আড়ষ্ট হয়ে যাই, কেন আমাদের মৌলিক লেখা সাবলীল ও সহজবোধ্য হলেও, অনুবাদে গুগল ট্রান্সলেটরের ভূত ভর করে?


যে-মন্তব্যগুলো পেলাম, সেগুলোর মূল সুর হচ্ছে: মূলকে ধরে রাখার চেষ্টা। মূল লেখার সঙ্গে প্রতারণা না-করা। নিজের কোনো মন্তব্য না-ঢোকানো। আর এগুলোর ফলাফল প্রায় রোবটিক অনুবাদ বা গুগল ট্রান্সলেশন।

এই পোস্টে আমি চেষ্টা করব, অনুবাদকদের কিছু মিথ ভাঙার। এবং কীভাবে সাবলীল অনুবাদ করা যায় সে ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অধ্যয়ন ভাগাভাগি করার।

অনুবাদ নিয়ে মিথ
অধ্যাপক হায়াত মামুদ তাঁর "বেঈমান তর্জমা" বইতে একটি কথা বলেছিলেন: ইতালিয়ান ভাষায় একটা প্রবাদ আছে: "Tradittore Traditor"। এর ইংরেজি অনুবাদ "Translator Traitor"। আর সেখান থেকেই তাঁর বইয়ের নামকরণ "বেঈমান তর্জমা"।

বইতে উনি মূলত যে-বিষয়টা সামনে আনতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, যেকোনো অনুবাদই মূল থেকে সরে আসবে: এটাই স্বাভাবিক। অনুবাদ যতই মূলানুগ হোক না কেন, তা কখনোই মূলের হুবুহু হবে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন এক ভাষার একটি রচনা কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করার পর যখন আবার প্রথম ভাষায় অনুবাদ করা হয়, তখন দেখা যায় তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কাজেই যতই মূলানুগ অনুবাদ করার চেষ্টা হোক, সেটা মূল থেকে সরবেই। সুতরাং মূলকে ধরে রাখার চেষ্টা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। বরং আমাদের উচিত অনুবাদের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমাদের অনুবাদকে সহজপাঠ্য করা।

অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য
আমরা অনুবাদ করি বিদেশি ভাষার রচনার মূল বক্তব্য যেন নিজের ভাষার মানুষ বুঝতে পারে সেজন্য। এখন আমাদের অনুবাদ যদি এমন হয় যে, সেটা পড়ে পাঠক বুঝলেনই না কী বলা হলো তাহলে আর সেই অনুবাদ করে লাভ কী? হ্যাঁ বিষয়বস্তুর কঠিনতার উপর অনুবাদ সহজ বা কঠিন হতে পারে। এখন ভাষার কঠিনতা যদি কঠিন বিষয়বস্তুর অনুবাদকে আরও কঠিন করে তোলে তাহলে পাঠকের জন্য তা বিস্বাদ ছাড়া আর কিছু হবে না। সেজন্য ভাবানুবাদই অবশ্যকর্তব্য।

বিষয়টা এমন না যে, সব বাক্যেরই ভাবানুবাদ করতে হবে। এমন কিছু বাক্য আছে যেগুলো আক্ষরিক অনুবাদ করলেও বাংলা বাংলা মনে হয়। কিন্তু রচনার ফাঁকে ফাঁকে এমন কিছু বাক্যও থাকে যেগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করলে রং-রূপ-রস সব হারিয়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে ভাবানুবাদ করা ছাড়া উপায় থাকে না। ভাবানুবাদ মানে এই না যে, আপনি ইচ্ছেমতো মূল বক্তব্যের উপর রং ছড়াবেন। বরং ভাবানুবাদ বলতে আমি এটাই বুঝি যে, যে-কথা লেখক ইংরেজিতে বলেছেন, সেকথা বাংলায় হলে আমি কীভাবে বলতাম, সেভাবে বলা। প্রশ্নটা গুরুগম্ভীর বা সারল্যের নয়। প্রশ্নটা সাবলীলতার। ভাবানুবাদও গুরুগম্ভীর হতে পারে। কিন্তু আক্ষরিক অনুবাদ করতে যেয়ে আপনি এমনভাবে বাক্য রচনা করলেন যেটা বাংলাতে যদি মৌলিকভাবে লিখতে হতো, তাহলে কেউ সেভাবে লিখত না—তাহলে বলব আপনার অনুবাদ ঠিক হয়নি।

অনুবাদের ইংরেজি-আরবি গন্ধ থাকার আরও দুটি কারণ
লেখা মৌলিক হোক কি অনুবাদ—লেখালেখির ক্ষেত্রে পণ্ডিতদের মন্তব্য হচ্ছে প্রথমবার যা লেখা হয়, সেটা আদৌ প্রকাশযোগ্য হয় না। চূড়ান্ত কপি অবশ্যই বার কয়েক কাটাকাটির ফল। আমার মনে হয়, আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই যেসব আক্ষরিক অনুবাদ দেখি, তার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, অনুবাদ করার পর সেটি আর দ্বিতীয়বার না-পড়া। অর্থাৎ নিজেই সম্পাদনা না-করা। এক্ষেত্রে পণ্ডিতদের পরামর্শ হচ্ছে: প্রথমবার লেখা শেষ করে সেটি কিছুদিন বা কমপক্ষে এক ঘন্টার জন্য ফেলে রাখা। এরপর সেটি জোরে জোরে পড়া। জোরে জোরে পড়লে নিজেই বুঝতে পারবেন কোন জায়গায় কাটাছেঁড়া জরুরি।

দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে ইংরেজিতে (এবং আরবিতেও) যৌগিক ও জটিল বাক্যের অনেক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাংলায় সাধারণত জটিল বাক্যের অত চল নেই। জটিল বাক্য পড়তে গিয়ে পাঠক ক্লান্তি বোধ করেন। এটা ঠিক একটা চমৎকার রচনায় সবধরনের বাক্যেরই মিশেল থাকে। কিন্তু প্রতি দুই লাইনে যদি একটা করে জটিল বাক্য পাওয়া যায়, তাহলে সেটা পাঠক পড়ে শেষ করবেন কীভাবে? আর পড়ে শেষ করলেও তা থেকে কতটুকু বুঝবেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়।


আমার শেষকথা হচ্ছে, মূলকে ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা না-করে সাবলীল অনুবাদ করুন। একটা অনুচ্ছেদ বা বাক্য পড়ে মূল ভাবটা নিজের ভাষায় নিজের মতো সাজান। এতে সৃষ্টিরও আনন্দ পাবেন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, একই কথা বাংলায় লিখতে হলে আমি কীভাবে লিখতাম। তাহলেই দেখবেন সাবলীল অনুবাদ সহজ হয়ে যাবে। অনুবাদক প্রতারক—এই বিশেষ সত্য মেনে নিয়েই অনুবাদ করুন। আপনার অনুবাদ তখন কেবল নীরস ভাষান্তর হবে না, হয়ে উঠবে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম।

2 comments:

  1. জাযাকাল্লাহ ভাই, গতকাল একটি অনুবাদ করতে যেয়ে আমি ঠিক এই সমস্যাগুলোরই সম্মুক্ষীন হয়েছি। আপনার টিপ্সগুলো বেশ কাজে লাগবে আশা করি।

    ReplyDelete

আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।