প্রথম ভাগ — কে আমাদের স্রষ্টা?
মূল: ড. লরেন্স ব্রাউন (Dr. Lawrence Brown)
জীবনের
কোনো এক পর্যায়ে যেয়ে সবার মনেই এই প্রশ্ন জাগে: “কে আমাদের সৃষ্টি করেছেন?”, “কেন
আমরা এখানে এসেছি?”
তো
কে আমাদের সৃষ্টি করলেন? আমাদের অধিকাংশ মানুষই ধর্মের মাঝে যতটা না বেড়ে উঠেছি
তার চেয়ে বেশি বেড়ে উঠেছি বিজ্ঞানের মাঝে। আর তাই আমরা স্রষ্টাকে যতটা না বিশ্বাস
করি তার চেয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণ ও বিবর্তন তত্ত্বকে।
কিন্তু কোনটা বেশি অর্থবহ? বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব যে পাশাপাশি অবস্থান
করতে পারে না এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
মহা
বিস্ফোরণ হয়তো মহাবিশ্ব সূচনার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু মহা বিস্ফোরণের
জন্য যে আদি ধূলিকণার প্রয়োজন ছিল সেটা কোথা থেকে এল সেই ব্যাখ্যা সে দিতে পারে
না। নিশ্চয় কোথাও-না-কোথাও থেকে এসেছে এই ধূলিকণা দুটো। এ
দুটোর মধ্যে এত পরিমাণ পদার্থ ছিল যে শুধু আমাদের গ্যালাক্সিই নয় এ ধরনের আরও কোটি কোটি গ্যালাক্সির
জন্ম দিতে পেরেছে। এখন প্রশ্ন হলো এই ধূলিকণা কোথা থেকে এল? কে বা কী এই আদি
ধূলিকণা সৃষ্টি করেছে?
অনুরূপভাবে
বিবর্তনতত্ত্ব জীবাশ্মের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতে পারলেও, মানব জীবনের সবচেয়ে
মৌলিক সত্তা—আত্মার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আমাদের সবারই আত্মা আছে। এর উপস্থিতি
আমরা টের পাই ঠিকই। আমরা এর অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলি; কখনো কখনো এর পরিত্রাণের জন্য
প্রার্থনা করি। এ বিষয়ের উপর সঠিক তথ্য দিতে পারবেন কেবল তাঁরাই যাঁরা এ বিষয়ে
বিশেষজ্ঞ। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব (The theory of natural selection) জীবনের
বস্তুগত দিকের অনেক ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, আত্মার ব্যাখ্যায় এসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
অধিকন্তু,
জীবন ও জগতের জটিলতা নিয়ে যে কেউই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে সে-ই স্রষ্টার
স্বাক্ষর খুঁজে পাবে। স্রষ্টার এই নিদর্শনগুলো সবাই শনাক্ত করতে পারবে কি না সেটা
অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। পুরোনো একটা প্রবাদ আছে—denial isn't just a river in Egypt. (বুঝেছেন? Denial, আসলে “de Nile”...the river Ni...ব্যাপার না।)
কোনো
চিত্রকর্ম দেখলে আমরা বুঝি কোনো চিত্রকর এই চিত্রকর্মটি এঁকেছেন। ভাস্কর্য দেখলে
আমরা বুঝি কোনো ভাস্কর এই ভাস্কর্য তৈরি করেছেন; মাটির তৈরি পাত্র দেখলে বুঝি কোনো
কুমারের নিপুণ হাতের কাজ এটা। অনুরূপভাবে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিশৈলী দেখেই কি
আমাদের বোঝা উচিত না যে এর পেছনেও রয়েছেন সুনিপুণ কোনো কারিগর? মহাজগত সৃষ্টির
শুরু প্রথমে এক বিস্ফোরণ মাধ্যমে; এরপর এলোমেলো কিছু ঘটনা আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের
মাধ্যমে এটি ভারসম্যপূর্ণ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে—এ ধরনের প্রস্তাব আর ময়লা
আবর্জনার মধ্যে বোমা ফেলে একটি পূর্ণাঙ্গ মার্সিডিজ গাড়ি তৈরির ধারণার মধ্যে খুব
একটা পার্থক্য নেই।
নিয়ন্ত্রণ
ছাড়া যেকোনো সিস্টেমই পরিণত হয় বিশৃঙ্খলায়। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ ও বিবর্তনতত্ত্ব
কিন্তু উল্টোটাই বলে—বিশৃঙ্খলা থেকেই এসেছে পরিপূর্ণতা। বরং এটা ভাবাই কি
অধিক যৌক্তিক না যে, মহাবিস্ফোরণ ও বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ন্ত্রিত কোনো ঘটনা? স্রষ্টা
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত?
আরব
বেদুইনদের একটি গল্প আছে। কোনো এক যাযাবর নিষ্ফলা মরুপ্রান্তরে এক চমৎকার প্রাসাদ
দেখে জিজ্ঞেস করল, কে এটি বানিয়েছে? প্রাসাদের মালিক বলল, প্রাকৃতিক শক্তির
মাধ্যমে এটা একা একাই তৈরি হয়েছে। বাতাস পাথরগুলোকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে এখানে নিয়ে
এসেছে, তারপর সেগুলোকে একত্র করে এই প্রাসাদের আকৃতি দিয়েছে। তারপর পাথরগুলোকে
জুড়ে দেওয়ার জন্য বালির মধ্যে বৃষ্টি ঝরিয়ে সিমেন্ট তৈরি করেছে। এরপর ভেড়ার পশমকে
উড়িয়ে এনে তা থেকে গালিচা আর বিচিত্র সব বুননের পর্দা, কাপড় তৈরি করেছে। কাঠগুলোকে
ভাসিয়ে এনে সুন্দর সুন্দর সব আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, চৌকাঠ তৈরি করেছে। তারপর
সবগুলোকে মনোরম এই অট্টালিকার একদম সঠিক জায়গায় ঠিকঠাকমতো বসিয়েছে।
বালুর
উপর বজ্রপাত হয়ে সেগুলোকে কাঁচে পরিণত করে জানালার রূপ দিয়েছে—কালো মাটিকে গলিয়ে
স্টিল তৈরি করেছে এরপর সেগুলোকে দরজার রূপ দিয়ে নিখুঁতভাবে জায়গামতো বসিয়েছে।
বিলিয়নের পর বিলিয়ন বছর লেগেছে এই কাজগুলো হতে, আর কাকতালীয়ভাবে পৃথিবীর কেবল এই
একটা জায়গাতেই এই ঘটনা ঘটেছে।
চোখ
কচলানো শেষে আমরা আসল কাহিনি বুঝতে পারি। পরিকল্পনার মাধ্যমেই এমন প্রাসাদ নির্মিত
হয়েছে, কাকতালীয়ভাবে কিছুই হয়নি। তো প্রাসাদ নির্মাণের বেলায় ব্যাপারটা যদি এমন
হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রাসাদের চেয়েও আরও জটিল সৃষ্টি—মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে মূল
কর্তা কে?
স্রষ্টা
সবকিছু শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এই বিশ্বাস খণ্ডন করার জন্য অনেকে এই ওজর তোলেন
যে, সৃষ্টি নিখুঁত নয়। স্রষ্টা যদি থাকেনই তাহলে এত অন্যায়, নৈরাজ্য কীভাবে হয়।
তারা যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন জন্মগত ত্রুটি থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ,
দাদীর ক্যান্সার কিংবা গণহত্যা এগুলো সবকিছুকে। তবে মূল কথা এটা নয়।
মূল কথা হচ্ছে যারা এসব অন্যায় অবিচারের যুক্তি দেখিয়ে স্রষ্টাকে অস্বীকার করতে
চান, তারা অনুমান করে নিয়েছেন যে, কোনো ঐশী সত্তা নিখুঁত না করে এই ধরণি সৃষ্টি করতে
পারেন না এবং পৃথিবীতেই তিনি পরিপূর্ণ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।
এর
বিপরীতে আমরা সহজেই বলতে পারি যে, স্রষ্টা পৃথিবীকে স্বর্গ হিসেবে সৃষ্টি করেননি।
বরং পৃথিবীকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক পরীক্ষা হিসেবে। স্রষ্টার পূর্ণাঙ্গ সুবিচার
প্রতিষ্ঠিত হবে পরকালে যেখানে সকল অন্যায়-অবিচার ও ভালো কাজের সুবিচার করা হবে। এই
প্রস্তাবের পক্ষে আমরা এই প্রমাণ পেশ করতে পারি যে, দৈনন্দিন জীবনে কারা সবচেয়ে
বেশি কষ্ট ভোগ করেছেন? সবচেয়ে বেশি অবিচারের স্বীকার হয়েছেন? নাবিরা। রাসূলরা।
স্রষ্টার বার্তাবাহকেরা। আর কারা জান্নাতের সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদায় আসীন হবেন?
দুনিয়ার জীবনে যারা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের স্বীকার হয়েছেন সেসব ন্যায়নিষ্ঠ নাবিগণ।
কাজেই দুনিয়াতে কষ্টভোগ করা মানেই এই না যে, স্রষ্টা কারও প্রতি জুলুম করছেন। আবার
দুনিয়াতে কারও সুখে থাকা মানে এই না যে, পরকালেও সে চিরসুখের জান্নাত পাবে।
যুক্তিপ্রয়োগের
এই পর্যায়ে এসে আমি আশা করি প্রথম “মহা প্রশ্ন”-র ব্যাপারে আমরা একমত হতে পেরেছি। আমাদের
কে সৃষ্টি করেছেন? আমরা কি এই ব্যাপারে একমত হতে পারি যে, যদি আমরা সৃষ্টি হয়ে
থাকি, তাহলে আমাদের স্রষ্টা ঈশ্বর?
যদি
একমত না-হই তাহলে আর এই আলোচনা বাড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু যারা একমত, তাদের জন্য চলুন
আমরা দ্বিতীয় মহাপ্রশ্নের উত্তর খুঁজি—কেন আমরা এখানে? অন্য কথায় আমাদের জীবনের
উদ্দেশ্য কী?
দ্বিতীয় ভাগ — জীবনের উদ্দেশ্য
জীবনের
দুটো মহাপ্রশ্নের প্রথমটি ছিল “কে আমাদের সৃষ্টি করেছেন?” আগের প্রবন্ধে আমরা সেটা
নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি স্রষ্টার ব্যাপারে আমরা একমত হতে পেরেছি। আমরা যেহেতু
সৃষ্টি, সেহেতু ঈশ্বর আমাদের স্রষ্টা।
এখন
আসুন আমরা দ্বিতীয় মহাপ্রশ্নের উত্তর খুঁজি: “কেন আমরা এখানে?”
তো,
কেন আমরা এখানে? খ্যাতি আর সম্পদ গড়ার জন্য? সংগীত আর সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য?
নাকি কবরে যাওয়ার আগে এই নাম কামানোর জন্য যে, আমিই ছিলাম সবচেয়ে ধনী পুরুষ বা
নারী?
না,
জীবনের অর্থ এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু; কাজেই আসুন সেটা নিয়ে একটু ভেবে দেখি। আপনার
চারপাশে চোখ বুলিয়েই শুরু করা যাক। আপনি যদি কোনো গুহার মধ্যে না থাকেন, তাহলে
আপনার চারপাশে এমন অনেক কিছুই দেখবেন যেগুলো মানুষ তার নিজ হাতে তৈরি করেছে। কেন
আমরা এগুলো তৈরি করেছি? অবশ্যই আমাদের নির্দিষ্ট কোনো প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই। এক
কথায় বলা যায়, আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আমরা বিভিন্ন জিনিস তৈরি করি। এই
কথাটাকেই আরেকটু বৃহৎ পরিসরে নিয়ে বলতে পারি, স্রষ্টা কেন আমাদের বেহুদা সৃষ্টি
করবেন যদি-না আমরা তাঁর প্রতি আমাদের কর্তব্য পালন করি?
আমরা
যদি আমাদের স্রষ্টাকে স্বীকার করি এবং এটাও স্বীকার করি যে, তাঁর প্রতি কর্তব্য
পালনের জন্যই তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাহলে পরবর্তী প্রশ্নটি হচ্ছে, “কীভাবে
তাঁর প্রতি আমাদের কর্তব্য পালন করব?” নিঃসন্দেহে এই প্রশ্নের উত্তর তিনিই ভালো
দিতে পারবেন যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি যদি আমাদেরকে তাঁর প্রতি কর্তব্য
পালনের উদ্দেশ্যে তৈরি করে থাকেন, তাহলে তিনি চাবেন যে নির্দিষ্ট এক উপায়ে আমরা
যেন সেই উদ্দেশ্য পালন করি। কিন্তু কীভাবে আমরা জানব যে সেই উপায় কী? আমরা কীভাবে
জানব স্রষ্টা আমাদের কাছ থেকে কী চান?
ঠিক
আছে, এভাবে ভেবে দেখুন: স্রষ্টা আমাদের আলো দিয়েছেন। সেই আলোর মাধ্যমে আমরা আমদের
পথ খুঁজে নিই। এমনকি রাতেও আলোর জন্য রয়েছে চাঁদ, দিক নির্ণয়ের জন্য রয়েছে তারা।
অন্যান্য প্রাণীকে তাদের অবস্থা ও প্রয়োজনের উপযোগী দিকনির্দেশক ব্যবস্থা দিয়েছেন।
দেশান্তরি পাখিরা মেঘে ঢাকা দিনেও দিক নির্ণয় করতে পারে। সূর্যের অবস্থান কোনদিকে
সেটা বুঝে নিতে পারে তারা। পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র “পড়া”র মাধ্যমে তিমিরা এক স্থান
থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। স্যালমন মাছ গন্ধ শুঁকে শুঁকে বিশাল সমুদ্রে তাদের
জন্মের স্থানে ফিরে যেতে পারে। মাছ তার শরীরের প্রেশার রিসেপটরের মাধ্যমে দূরবর্তী
কোনো নড়াচড়া বুঝতে পারে। বাদুড় ও এক ধরনের ডলফিন সোনারের (Sonar) মাধ্যমে
দেখে থাকে। কিছু সামুদ্রিক প্রাণী এমন ধরনের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র উৎপাদন করে ও পড়তে
পারে যা তাদেরকে ঘোলা পানি কিংবা গভীর সমুদ্রেও পথ চলতে সাহায্য করে। পোকারা
ফেরোমন (Pheromone) প্রক্রিয়ায় একে অপরের সাথে যোগাযোগ
করে। উদ্ভিদজাতি সূর্যের আলো আঁচ করে সেদিকেই বেড়ে ওঠে (phototrophism); অভিকর্ষ আঁচ করে মাটির নিচে ছড়িয়ে পড়ে তাদের মূল (geotrophism)। এক
কথায় বলতে গেলে স্রষ্টা সবধরনের প্রাণীকেই তাদের উপযোগী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাহলে
আমরা একথা কীভাবে বলতে পারি যে, স্রষ্টা আমাদেরকে আমাদের অস্তিত্বের জন্য কোনো
দিকনির্দেশনা দেননি? পরিত্রাণের জন্য কোনো উপায় বাতলে দেননি?
আর
সেই দিকনির্দেশনা প্রত্যাদেশ বাদে আর কী হতে পারে?
এভাবে
ভেবে দেখুন: প্রত্যেক পণ্যেরই গুণাগুণ ও নিয়মকানুন থাকে। পণ্য যতি জটিল হয়, তার
গুণাগুণ ও নিয়মকানুনও তত জটিল হয়। সেক্ষেত্রে পণ্যটি চালানোর জন্য আমরা
নির্দেশকগ্রন্থের (ইউজার ম্যানুয়াল) উপর নির্ভর করি। এই নির্দেশকগ্রন্থ সাধারণত
তিনিই লিখে থাকেন যিনি সেই পণ্যের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানেন অর্থাৎ
প্রস্তুতকারক। সাধারণত এধরনের বই শুরু হয় পণ্যের ভুল ব্যবহার ও এর ফলে যে ক্ষতি
হতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করে। এরপর পণ্যটি কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে সে
ব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকে। পণ্যটি থেকে কী কী উপকার বা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে
সেগুলোও উল্লেখ করা থাকে। এবং সবশেষে উল্লেখ থাকে কোনো সমস্যা হলে পণ্যটি কীভাবে
সারাতে হবে সেসব কথা।
এখন
চিন্তা করে দেখুন ইউজার ম্যানুয়ালের সঙ্গে প্রত্যাদেশের ফারাক কোথায়?
প্রত্যাদেশ
আমাদের বলে কী করতে হবে, কী করব না ও কেন, স্রষ্টা আমাদের কাছে কী চান এবং কীভাবে
আমরা আমাদের কমতিগুলো দূর করতে পারব উল্লেখ থাকে সেসব কথা। প্রত্যাদেশ হচ্ছে সেই
মৌলিক ইউজার ম্যানুয়াল যেখানে উল্লেখ থাকে কীভাবে মানুষ অর্থাৎ আমাদের চলতে হবে।
এই প্রত্যাদেশ আমাদের জন্য এক নির্দেশকগ্রন্থ।
পার্থিবক্ষেত্রে
কোনো পণ্য যদি তার উপযোগিতা প্রমাণ করতে পারে, কাজে লাগে তাহলে তাকে সেই পণ্যের
সফলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যদি পণ্যটি কাজে না লাগে... হুম্ম্... নিজেই
ভেবে দেখুন। কোনো পণ্য যদি তার গুণাগুণ অনুযায়ী কাজ করতে না পারে তাহলে তার
মেরামতের জন্য সার্ভিস সেন্টারে পাঠানো হয়। আর যদি একেবারেই ঠিক হওয়ার কোনো আশা না
থাকে তাহলে রিসাইকেলের জন্য ফেলে দেওয়া হয়। অন্যকথায় নষ্ট করে ফেলা হয়! আউচ। হঠাৎ
করেই আমাদের আলোচনা মনে হচ্ছে বেশ গুরুগম্ভীর হয়ে উঠেছে। কারণ এই আলোচনার পণ্য
আমরাই—সৃষ্ট পণ্য।
তবে
এক মুহূর্তের জন্য থেমে একটু ভেবে দেখুন আমাদের চারপাশে যেসব যন্ত্রপাতি, পণ্য
রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে আমরা কীরূপ আচরণ করি। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো পণ্য আমাদের চাহিদা
মেটায় ততক্ষণ আমরা সেসব পণ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। কিন্তু যখন সেটা আর কাজে লাগে
না, তখন আমরা ফেলে দিই। একসময় এর স্থান হয় ময়লা ফেলার ডাস্টবিনে... এরপর হয় পুঁতে
ফেলা হয় নয়তো পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনুরূপভাবে কোনো কর্মচারী যদি ঠিকমতো কাজ না করে
আমরা তাকে বরখাস্ত করি। পার্থিব জীবনের শিক্ষাকে যিনি ধর্মীয় শিক্ষার সাথে তুলনা
করতে পারবেন তিনিই এর সঠিক মর্ম বুঝতে পারবেন।
কাজেই
আমার মনে হয় বিষয়টা গভীরভাবে ভাবার দাবি রাখে। স্বর্গীয় সুখ আর নরক-যন্ত্রণা মোটেও
হাস্যকর বা হেলাফেলার কোনো বিষয় নয়।
তৃতীয় ভাগ — প্রত্যাদেশের প্রয়োজনীয়তা
আগের
দুই পর্বে আমরা আলোচনা করেছি দুটো “মহাপ্রশ্ন” নিয়ে। কে আমাদের সৃষ্টি করেছেন?
স্রষ্টা। আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি? স্রষ্টার উপাসনা করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই
তৃতীয় আরেকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়: “স্রষ্টা যদি আমাদেরকে তাঁর উপাসনার জন্য সৃষ্টি
করে থাকেন, তাহলে কীভাবে আমরা সেটা করব?” আগের প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম যে, একমাত্র
যেভাবে আমরা স্রষ্টার উপাসনা করতে পারি সেটা হচ্ছে তাঁর আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করে।
আর এগুলো জানার উপায় হচ্ছে প্রত্যাদেশ।
কিন্তু
অনেক লোকই আমার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন এই বলে যে, মানুষের কেন প্রত্যাদেশের
প্রয়োজন? ভালো থাকাটাই কি যথেষ্ট নয়? আমরা প্রত্যেকে যদি স্রষ্টাকে আমাদের নিজেদের
মতো উপাসনা করি তাতে ক্ষতি কী?
প্রত্যাদেশের
প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমার যুক্তিগুলো হচ্ছে: প্রথম প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছিলাম যে,
দুনিয়ার জীবন নানা অবিচারে পূর্ণ। কিন্তু আমাদের স্রষ্টা অবিচারক নন। তিনি শুধু এই
পৃথিবীতেই সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন না, প্রতিষ্ঠা করবেন পরকালেও। তবে চারটি জিনিস
ছাড়া এটা সম্ভব না—আদালত (অর্থাৎ বিচার দিন); বিচারক (অর্থাৎ স্রষ্টা); সাক্ষী
(অর্থাৎ নর-নারী, ফেরেশতা-ঐশী দূত); এবং আইন সংবলিত একটি বই, যে আইনের উপর বিচার
করা হবে (অর্থাৎ প্রত্যাদেশ)। এখন স্রষ্টা কীভাবে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন যদি
পার্থিব জীবনে ভালো ও মন্দের কোনো মানদণ্ড তিনি ঠিক করে না দেন? এটা অসম্ভব। যদি
কোনো আইনের বই-ই না-থাকে তাহলে স্রষ্টা বরং অবিচারই করে বসবেন। কেননা, সেক্ষেত্রে
তিনি হয়তো মানুষকে এমন সব কাজের জন্য শাস্তি দিতেন যেগুলো জানার কোনো উপায় মানুষের
ছিল না।
কেন
আমাদের প্রত্যাদেশ প্রয়োজন? প্রথমত, পথনির্দেশ ছাড়া মানবজাতি বিভিন্ন সামাজিক ও
অর্থনৈতিক ইস্যু, রাজনীতি, আইনকানুন ইত্যাদির ব্যাপারে একমত হতে পারে না।
সেক্ষেত্রে স্রষ্টার ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে একমত হবো? দ্বিতীয়ত, যিনি কোনো পণ্য
তৈরি করেন তার চেয়ে ভালোভাবে অন্য কেউ ইউজার ম্যানুয়াল লিখতে সক্ষম নন। ঈশ্বর
আমাদের স্রষ্টা, আমরা তাঁর সৃষ্টি এবং আমাদের ব্যাপারে তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ জানবেন
এটা অযৌক্তিক। কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কি ঠিক করে নেয় তাদের কাজ কী হবে?
নিজেদের মতো করে ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ তৈরি করে? আমরা নাগরিকেরা কি আমাদের নিজেদের
মনমতো আইন তৈরি করি? না। তাহলে আমরা কেন নিজেরা আমাদের নিজেদের মনমতো ধর্ম বানাব?
ইতিহাস থেকে যদি আমরা কেবল একটা শিক্ষা নিতে পারি তাহলে সেটা হচ্ছে, মানুষের
খেয়ালখুশির কারণে অজস্র বিয়োগান্তক পরিণতি তৈরি হয়েছে। মুক্তচিন্তার দাবিদার এমন
কত মানুষ নিজেদের মনমতো ধর্ম তৈরি করে নিজেদের এবং তাদের অনুসারীদের জীবনকে
দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। ধ্বংস করেছে পার্থিব ও পরকালীন জীবন।
দ্বিতীয়
যে যুক্তিটি মানুষ দিতে পারে তা হলো, কেন কেবল ভালো থাকাটাই যথেষ্ট নয়? কেন আমাদের
নিজেদের মতো স্রষ্টার উপাসনা যথেষ্ট নয়? এর উত্তরে বলব, “ভালো”র সংজ্ঞা
ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন রকম। কারও কাছে ভালো মানে উত্তম নৈতিকতা ও স্বাভাবিক জীবন,
কারও কাছে পাগলামি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। অনুরূপভাবে স্রষ্টার উপাসনার ক্ষেত্রেও
মানুষের ধারণা বিচিত্র রকমের। আপনি কোনো দোকানে কিংবা রেস্তোরাঁয় যেয়ে নিশ্চয় এমন
কোনো মুদ্রা ব্যবহার করে কিছু কিনতে পারবেন না যেটা সেই দোকান বা রেস্তোরাঁয় গ্রহণ
করা হয় না। একই কথা ধর্মের ক্ষেত্রেও খাটে। মানুষ যদি চায় যে তাদের উপাসনা স্রষ্টা
কবুল করুক, তাহলে সেটা সেভাবেই হতে হবে স্রষ্টা যেভাবে চান। আর সেটার খোঁজই রয়েছে
তাঁর প্রত্যাদেশের মধ্যে।
মনে
করুন, আপনার পরিবারে আপনি কিছু নিয়ম চালু করেছেন। এবং সেই নিয়ম অনুযায়ীই সবকিছু চলছে।
একদিন আপনার কোনো সন্তান এসে বলল, সে এই নিয়ম পাল্টে নিজের মতো করে চলবে। তখন
আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? সম্ভবত এরকমই কিছু একটা বলবেন যে, “তুমি তোমার নতুন
নিয়ম নিয়ে নরকে যাও!” এখন ভেবে দেখুন: আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাঁর তৈরি মহাবিশ্বে
তাঁর নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী চলছি। এখন কেউ যদি সেই বিধির ব্যতিক্রম করে তাহলে তার
জন্য জাহান্নামে যাওয়াটাই কি স্বাভাবিক না?
এক্ষেত্রে
আন্তরিকতা একটা বড় ব্যাপার। আমাদের বোঝা উচিত যে, সকল অনুগ্রহ স্রষ্টার পক্ষ থেকে
বিশেষ উপহার। এ কারণে স্রষ্টা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেউ যখন কোনো উপহার পায় তখন
ধন্যবাদ না-দিয়ে কে সেটা ব্যবহার করে? অথচ স্রষ্টার সব উপহার আমরা সারাজীবন ধরে
উপভোগ করছি কোনো ধন্যবাদ না-দিয়েই। কিংবা দিলেও অনেক দেরিতে।
আমাদের
কি উচিত না স্রষ্টার অগণিত উপহারের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া? তাঁর সঙ্গে যথাযথ
আচরণবিধি মেনে চলা? পুরো জীবনের জন্য? আমরা কি এজন্য তাঁর কাছে ঋণী নই?
আনমনেই
আপনার মুখে “হ্যাঁ” উত্তর চলে এসেছে। আসতেই হবে। একমত না-হলে এতদূর পর্যন্ত আপনি
পড়তেন না। কিন্তু এরপরও একটা সমস্যা আছে: আপনাদের অনেকেই এটা ভালো করে জেনেই “হ্যাঁ”
উত্তর দিয়েছেন যে, আপনাদের মন ও মগজ আপনাদের সামনে যেসব ধর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে সেগুলোর
ব্যাপারে পুরোপুরি একমত নয়। আপনি মানেন যে আমরা স্রষ্টা দ্বারা সৃষ্ট। কিন্তু আপনি
সেই স্রষ্টাকে বুঝতে পারছেন না। আপনার মন ব্যাকুলভাবে চাইছে যেভাবে তিনি নির্দেশ
দিয়েছেন সেভাবে তাঁর উপাসনা করতে। কিন্তু আপনি জানেন না সেটা কীভাবে। আপনি এটাও
জানেন না যে, কোথায় তার উত্তর পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা কোনো প্রবন্ধে
আলোচনা করার বিষয় নয়। সে উত্তর পাওয়া যাবে কোনো বইতে, কিংবা বইয়ের সিরিজে।
সুখবর
হচ্ছে সেজন্য আমি কিছু বই লিখেছি। আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি “দি এইট্থ স্ক্রল” বইটি
দিয়ে সেসব জবাব পাওয়ার অভিযাত্রা শুরু করার। এখানে যা লিখেছি তা যদি আপনাদের ভালো
লাগে, তাহলে সেখানে যা লিখেছি তা-ও আপনাদের ভালো লাগবে।
অথবা
ঢুঁ মারতে পারেন আমার ওয়েবসাইটে:
http://www.leveltruth.com/
মূল লেখার লিংক: http://www.tellmeaboutislam.com/the-big-question.html
No comments:
Post a Comment
আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।