28 January 2015

ঘুমিয়ে নেই খালেদা জিয়ারা; ঘুমিয়ে আছি আমরা

টেলিভিশনের সঙ্গে আমার দূরাত্মীয়মূলক সম্পর্ক চলছে গত প্রায় এক বছর ধরে। প্রচারমাধ্যমের পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন অনুষ্ঠান (অধিকাংশক্ষেত্রে) প্রচার দিনকে দিন টেলিভিশনের প্রতি আমার অনীহা বাড়িয়ে তুলছে। তবে বাসায় টিভি সেট থাকায় ইচ্ছে না-থাকা সত্ত্বে মাঝেমধ্যে চোখ চলে যায়, কানে বেজে ওঠে বিভিন্ন খবরাখবর। তেমনই কিছু খবর ব্রেকিং নিউজ হিসেবে টিভি পর্দার নিচে এসে আমার চোখকে টেনে ধরেছিল। প্রথম খবরটা ছিল এরকম যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে খালেদা জিয়ার বাড়িতে যাচ্ছেন সমবেদনা জানাতে। দ্বিতীয় খবরটা ছিল খালেদা জিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে আর গেট না-খোলায় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্থান। এরপর ঘটে গেছে আরও অনেক খবর; একের পর এক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসেবে।

পরবর্তী দুএকদিন মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক সাড়া দেখা গেল। কাজটা ভালো করেনি বিএনপি এমন মতামত দিলেন অনেক সাধারণ মানুষ। অনেকে উল্টো বললেন, বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে সমাবেশ করতে না-দিয়ে এখন আবার মাসীর দরদ দেখানোর প্রয়োজন কী?

কিন্তু যে-খবর আমাদের কাছে পৌঁছায় না, যে-অনুভূতি আমাদের নাড়া দেয় না—আমরা ঘুমিয়ে থাকি কিংবা ঘুমানোর ভাণ করি যে কথা শুনে তা হচ্ছে: গলে যাওয়া পঁচে যাওয়া গণতন্ত্রের পয়ঃনিষ্কাশন পাইপে শান্তির পায়রা ওড়ানোর পণ্ডশ্রম। সংলাপে আসবে শান্তি, দূরত্ব কমবে দুদলের মধ্যে, দেশে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা, অবসান ঘটবে সকল অরাজকতা ও দুর্নীতির—এমন শত শত মুখরোচক ক্যান্ডির মোড়কে ছাই আমরা চুষে চলেছি প্রতিনিয়ত; কিন্তু তবু আমাদের হুঁশ হচ্ছে না।

রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে সাধারণ জনতা। মাত্র গত ২৩ দিনে মারা গেছেন ৩৮ জন (সূত্র: প্রথম আলো)। আহত হয়েছেন অগণিত। এভাবেই চলছে একাত্তর পরবর্তী সোনার বাংলা। কিন্তু ঘুম ভাঙছে না আমাদের। আমরা বিভোর আশার ফানুসে। জনৈক স্যারদের কথামতো আমরা দিবারজনী অবিরাম স্বপ্ন দেখে চলেছি। কল্পরাজ্যের স্বপ্ন। কিন্তু খতিয়ে দেখছি না এভাবে কি আদৌ সম্ভব সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়া?

মুসলিম নামধারী আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই রয়েছে এক অমোঘ সংবিধান। যে সংবিধানে কোনো ফাঁকফোঁকর নেই। নেই কোনো চিপাগলি। নেই দুর্নীতির কোনো মওকা। যে সংবিধান অনুযায়ী শাসক হবেন সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর ব্যাপারে সদা-সচেতন, যাঁর চরিত্রে থাকবে না কোনো কালিমা; ইসলামি জ্ঞানে যিনি হবেন প্রাজ্ঞ, বিদ্বান এক ব্যক্তি। যাঁর উপদেষ্টা, সহযোগী হবেন এমন সব ব্যক্তিত্ব যাঁরা ইসলামি আইন ও শাস্ত্রে হবেন এক একজন বিশেষজ্ঞ। কোনো মুরগি চোর, ভণ্ড দেশপ্রেমী, শাসকের পা-চাটা বুদ্ধিজীবীর ঠাঁই নেই এখানে। এখানে চলবে শুধু এক আল্লাহর হুকুম। বরদাশত করা হবে না খোদ শাসকের ছেলে-মেয়ে কিংবা নিকটাত্মীয়েরও অপরাধ। প্রত্যেক মুসলিমের ঘরেই আছে সেই সংবিধান—আল-কুর’আন। কিন্তু আফসোস; কখনো আমরা সেই সংবিধান বোঝার উদ্দেশ্যে পড়িনি, মানার উদ্দেশ্যে পড়িনি। পড়েছি কেবল পুণ্য লাভের আশায়: প্রতি হরফে দশ নেকি এই আশায়। মর্মার্থ বোঝা হয়ে ওঠেনি কখনো। কি ব্যক্তিজীবন, কি পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবন—মানবতার সকল সমাধান আছে যে সংবিধানে, সেই অভ্রান্ত সংবিধান ছেড়ে আজ আমরা প্রায় ২৫০০ বছরের পুরোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বুঁদ হয়ে আছি। অথচ যে কুর’আন আমাদের সব সমস্যা মিটিয়ে দিত পারত, তাকে আজ আমরা বইয়ের তাকে সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দিয়ে ধুলো কুড়াচ্ছি।

নেতা-নেত্রীদের দোষ দিয়ে কী হবে? আমরা নিজেরাই তো এমন সব লোকদের নেতা-নেত্রীর পদে আসীন করেছি, যারা এর যোগ্য নন। শত হাজারোবার ঠোকর খাওয়ার পরও আমরা একই ভুলের বারবার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছি। আমরা ঘুমিয়ে আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। লাল-নীল-সাদা-কালো স্বপ্ন। কবে ভাঙবে আমাদের ঘুম? কবে জাগব আমরা? আমরা কি অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের জন্য যেদিন আমাদের নিজের ঘরে আগুন লাগবে? যেদিন জ্বলবে আমার নিজের শরীর? আমার প্রিয় ভাই-বোন কিংবা মা-বাবার শরীর? আমার প্রিয় স্ত্রী/স্বামী কিংবা প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তান যেদিন লাশ হয়ে ফিরবে সেদিন কি আমাদের ঘুম ভাঙবে?

প্রার্থনা করি এমনটা যেন না-হয়। সময় থাকতেই আমরা যেন জেগে উঠি। ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে শুধু নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে একে প্রয়োগ করতে শিখি। ইনশা’আল্লাহ আমরা তখন শুধু এই দুনিয়াতেই নয়, সফল হবো পরকালের অনন্ত জীবনেও। সেই অনন্ত জীবনের শান্তিই হোক আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

No comments:

Post a Comment

আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।