কুরআনের যে কয়টি সূরা আমার খুব খুব ভালো লাগে তার মধ্যে সূরা হুজুরাত অন্যতম। এ সূরার মোট আয়াত তেমন বেশি না; মাত্র ১৮ টা। কিন্তু প্রতিটা আয়াতই এক একটা অমূল্য উপদেশের খনি। এমনিতেই গোটা কুরআন আল্লাহর কথা। আর এ সূরার আয়াত এবং তার অর্থগুলো পড়লে আরও বেশি করে আল্লাহর কথার উপস্থিতি টের হয়। সত্যি সত্যি মনে হয় তিনি সবগুলো কথা যেন আমাকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে বলছেন।
শুরুতে প্রথম ৩টি আয়াত পড়ে নিই সুন্দর করে।
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تُقَدِّمُوا۟ بَيْنَ يَدَىِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿١﴾ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَرْفَعُوٓا۟ أَصْوَٰتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ ٱلنَّبِىِّ وَلَا تَجْهَرُوا۟ لَهُۥ بِٱلْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَـٰلُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ ﴿٢﴾ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَٰتَهُمْ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُو۟لَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمْتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ ۚ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ ﴿٣﴾
এর ভাবানুবাদ হচ্ছে:
﴾এই যে বিশ্বাসীরা, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আগে বেড়ে যেয়ো না। আল্লাহকে ভয় করো। তিনি কিন্তু সব শোনেন। সব কিছু জানেন। নবির গলার উপরে তোমাদের গলা উঁচু করবে না। একে অপরের সঙ্গে যেভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলো তাঁর সঙ্গে সেভাবে কথা বলবে না। তাতে তোমাদের অগোচরে তোমাদের ভালো ভালো কাজগুলো বরবাদ হয়ে যাবে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে গলা নামিয়ে রাখে, আল্লাহ তাদের মনগুলোকে তাক্বওয়া দিয়ে পরিশোধিত করে দেন। এদের জন্যই তো আছে ক্ষমা আর অসামান্য পুরস্কার।﴿
যারা আরবি বোঝেন তারা তো বোঝেনই, আর যারা বোঝেন না এই ভাবানুবাদ পড়ে তাদের কি মনে হচ্ছে না যে আল্লাহ সরাসরি কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে?
তাফসীর নোটসে আসি এবার। নিচে আমি যে ব্যাখ্যাগুলো বলব তা শুধু তাফসীর ইবনু কাসীর থেকে আমার উপলব্ধি ও সারসংক্ষেপ। এখানে যা কিছু ভালো তা আল্লাহর তরফ থেকে। যা কিছু খারাপ তা আমার ও শয়তানের তরফ থেকে।
ইবনু কাসীর কে তা হয়তো অনেককেই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই; বিশেষত যারা ইসলাম অনুরাগী। তবে যারা তাকে চেনেন না তারা একটু উইকিপিডিয়াতে তাফসীর ইবনু কাসীর লিখে তালাশ করলেই অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। এক কথায় বলতে হলে বলব কালোত্তীর্ণ কুরআন ব্যাখ্যাবইগুলোর মধ্যে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহ়িমাহুল্লাহ)-এর এই বইটি সবদিক দিয়ে সেরা। এর সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে ইবনু কাসীর কুরআনকে ব্যাখ্যা করেছেন প্রথমে কুরআন, তারপর হাদীস, তারপর সাহাবিদের উক্তি, তারপর সাহাবিদের শিক্ষার্থীদের উক্তি দিয়ে। এজন্য এখানে কুরআনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সবচে বিশুদ্ধ ও আদি অর্থে। ভুলভ্রান্তির অবকাশ সবচে কম এখানে।
অনেক কথা হয়ে গেল। আসল কথায় আসি।
পুরো সূরাটিতেই আল্লাহ আমাদেরকে বিভিন্ন আদব শিখিয়েছেন। একজন বাবা কিংবা মা যেভাবে তার সন্তানকে হাতে ধরে ধরে সবকিছু শেখান কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁর সেরা সৃষ্টিকে এভাবেই চলার পথের সবকিছু শিখিয়েছেন।
আয়াতের প্রথম অংশে আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ আগ বাড়িয়ে যেতে না করেছেন। এর মানে কী?
মু‘আয বিন জাবালকে আল্লাহর রাসূল ﷺ ইয়েমেনে প্রশাসক করে পাঠিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সেখানে গিয়ে সে কোন আইন অনুসারে শাসন করবে। সাহাবি মু‘আয অত্যন্ত চমৎকার এক জবাব দিয়েছিলেন। সে জবাব শুনে আল্লাহর রাসূল তার বুক চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, “সেই সত্ত্বার জন্য সব প্রশংসা যিনি তাঁর রাসূলের দূতকে এমন কথা বলার সামর্থ্য দিয়েছেন। তার সঙ্গে তাঁর রাসূল একমত।”
মু‘আয বলেছিলেন প্রথমে তিনি কুরআনের আইনে শাসন করবেন। কুরআনে না পেলে রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ দিয়ে। সুন্নাতে না পেলে নিজের মত দিয়ে বা ইজতিহাদ করে।
খেয়াল করে দেখুন শুরুতেই উনি নিজের মত দিয়ে শাসন করবেন বলেননি। আগে কুরআন, তারপর সুন্নাহ। এরপর নিজের মত বা ইজতিহাদ। বর্তমান বিশ্বের যেসকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করেন তারা কি এই আয়াতটা খেয়াল করবেন একটু?
নবিজি তাঁর চাচাত ভাই ইবনু ‘আব্বাসকে কুরআনের বুঝ দেওয়ার জন্য বিশেষ দু‘আ করেছিলেন। আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন এখানে কুরআন-সুন্নার পরিপন্থী যেকোনো কথা বলতে মানা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূলের আগে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
আর তাবি‘গণদের কথার সারমর্ম হচ্ছে:
- নবিজির মুখে আল্লাহর সিদ্ধান্ত শোনার আগে কেউ যেন কোনো রায় না দেয়
- শারী‘আর বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ডিঙিয়ে কেউ যেন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়।
- আচার-আচরণ এবং কথাবার্তায় তাঁদের আগ বেড়ে কেউ না যায় যেন
- ইমামের আগে দু‘আ না করে।
আয়াতের শেষে আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন আমরা যেন সশ্রদ্ধ ভয় করি তাকে। তিনি হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন তিনি কিন্তু আমাদের সব কথা শোনেন। মনের গহীন নিয়তও জানেন।
আসলে আল্লাহকে যিনি সত্যি সত্যি ভয় করেন, যার মন আল্লাহর ভাবনায় সদামশগুল কেবল তার পক্ষেই সম্ভব এ নির্দেশ মানা। আমরা যখন হৃদয় দিয়ে বুঝব তিনি আমাদের সব কথা শোনেন, মনের সব খবর রাখেন তখন কোনোভাবেই তাঁর হুকুমের পরিপন্থী কিছু করা সম্ভব না।
পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন পরস্পরের সঙ্গে কখনো কখনো আমরা যেভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলি তাঁর রাসূলের সাথে যেন সেভাবে কথা না বলি।
ইবনু কাসীর বলেছেন আয়াতটা আবু বাক্র ও ‘উমারের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের জের ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাদের দুজনের উপর সন্তুষ্ট থাকুন। একবার কোনো একটি বিষয়ে তাদের দুজনের মাঝে বাদানুবাদ হয়। তখন এ আয়াতের মাধ্যমে তাদের সাবধান করে দেওয়া হয়।
বলাবাহুল্য এ সাবধানবাণী আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য। এজন্যই সাবিত বিন কাইস আয়াতটি শুনে ঘরের কোণে বসে কাঁদছিলেন নিজের সর্বনাশের কথা চিন্তা করে।
তার গলার স্বর কিছুটা উঁচু ছিল। এ আয়াত শোনার পর তার আশঙ্কা হলো যেহেতু তিনি কথা বলার সময় তার গলার স্বর নবিজির গলার স্বরের চেয়ে উঁচু হয়, কাজেই তিনি বোধ হয় জাহান্নামে এক পা দিয়েই ফেলেছেন।
তার এই অবস্থা জেনে নবিজি ﷺ জানালেন তিনি জাহান্নামি নন। তিনি বরং জান্নাতি। নবিজির বাণীকে সত্য প্রমাণিত করে ইয়ামামার লড়াইয়ে শহিদ হন সাবিত বিন কাইস। আল্লাহর রাসূলের উপর কথা না বলার পুরস্কার যে কত বড় তা কি বুঝতে পারছি আমরা?
আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে সাহাবিরা সবসময় মনে করতেন আয়াতগুলো বুঝি তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। অথচ আমাদের বেলায় বিষয়টি যেন পুরো উল্টো। বিশেষ করে কোনো আয়াতে যদি কোনো কাজের নিন্দা করা হয়, কোনো বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয় আমরা ভাবি কথাটা যেন আমাকে না, গতকাল রাতে ফেইসবুকে যার সঙ্গে এক চোট বাদানুবাদ হলো, তাকে নিয়ে বলা।
এই তো একটু পড়েই আল্লাহ আমাদের বলবেন আমরা যেন কোনো খবর যাচাই না করে প্রচার না করি। এটা পড়েই মনে হবে আরে ঐ লোকটা যে সৌদি-সরকার বিরোধী নানা খবর প্রচার করছে সে কি আসলেই যাচাই করে প্রচার করছে? অথচ এটা আমার নিছক অনুমান। আর অল্প কিছু আয়াত পর আমরা দেখব আল্লাহ আমাদেরকে অনুমান করতেও মানা করছেন। বুঝলেন তো আমরা কীভাবে প্রতিটা আয়াতকে অন্যের উপর প্রয়োগ করি? এই যেমন আমাকে নিয়ে হয়তো এই মুহূর্তে কারও কারও মনে সন্দেহ জাগতে পারে লোকটা সৌদি-সরকার সমর্থক কি না। না হলে সৌদি-সরকার বিরোধী খবরের উদাহরণ দিতে গেল কেন!
যাক সে কথা। আগে বাড়ি আমরা।
আমাদের নবিজি যে কত সম্মানিত, শুধু তাঁর সামনে কেন, তাঁর মাসজিদ এমনকি তার কবরের সামনেও যে জোরে কথা বলা আপত্তিকর সে দিকটাও তুলে এনেছেন ইবনু কাসীর।
তাইফের দুজন লোক একবার মাসজিদুন-নাবাউইতে জোরে জোরে কথা বলছিলেন। তখন ‘উমার ইবনুল-খাত্তাব মুসলিম বিশ্বের খলীফা। তারা কোথাকার লোক সেটা জানার পর তিনি জানালেন, “তাইফের না হয়ে তোমরা যদি মাদীনার হতে তাহলে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলতাম।”
আমাদের নবিজি জীবিত ও মৃত—সব অবস্থায় সম্মানিত। ‘আলিমগণ তাঁর কবরের আশেপাশেও তাই জোরে জোরে কথা বলাকে ঘৃণিত কাজ বলেছেন।
কথাবার্তায় আদব বজায় রাখা, সাবধান থাকা খুব জরুরি এজন্য। আল্লাহর রাসূল জানিয়েছেন অনেক সময় আমরা আল্লাহর সন্তোষজনক একটা কথা হয়তো অত গুরুত্ব না দিয়েই বলে ফেলি। অথচ সেটা আমাদের জান্নাতের কারণ হয়ে যায়। আবার হালকা মনে করে অসন্তোষজনক অনেক কথা বলে ফেলি। যেটা আমাদের জাহান্নামের কারণ হয়।
তো বুঝতেই পারছেন কুরআন-সুন্নাহ বা ইসলাম নিয়ে কিছু একটা বলে ফেলার আগে কত সতর্ক থাকা উচিত আমাদের।
এই আয়াত ত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর অংশটা বুঝি এখানে: ﴾যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে গলা নামিয়ে রাখে, আল্লাহ তাদের মনগুলোকে তাক্বওয়া দিয়ে পরিশোধিত করে দেন।﴿
তাক্বওয়া কী সেটা নিয়ে আরেক দিন কথা বলা যাবে। সূরা বাক্বারার দ্বিতীয় আয়াত নিয়ে যখন নোটস লিখব সেদিন বিস্তারিত বলব, ইনশা আল্লাহ। এখানে শুধু সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি তাক্বওয়া মানে সবসময় আল্লাহর স্মরণ রাখা। আল্লাহকে ভয় করে বাছবিচার করে চলা।
ইবনু কাসীর বলছেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার উপর কথা বলে না তাদের মনটাকে তাক্বওয়ার সোনায় মুড়ে দিতে খাঁটি করে নিয়েছেন আল্লাহ। এদের জন্যই আছে ক্ষমা। অসামান্য পুরস্কার।
ইমাম আহমাদের কিতাবুয-যুহ্দ থেকে চমৎকার একটি বর্ণনা উল্লেখ করে শেষ করব আজকের নোটস। ইবনু কাসীরই উল্লেখ করেছেন এটি।
একবার খলীফা ‘উমারের কাছে চিঠিতে একজন লোক জানতে চাইলেন, “যার মনে পাপের কোনো স্পৃহা জাগে না সে বেশি ভালো, নাকি যার মনে পাপ করতে উসখুস করে, কিন্তু তারপরও পাপ কাজটা করে না সে বেশি ভালো?”
খলীফা জবাবে লিখলেন: “যার মনে পাপের স্পৃহা জাগে কিন্তু করে না ﴾তাদের মনগুলোকে আল্লাহ তাক্বওয়া দিয়ে পরিশোধিত করেছেন। তাদের জন্যই আছে ক্ষমা আর অসামান্য পুরস্কার।﴿”
শেষ করার আগে দুটা কুইজ:
যুবক বয়সে দৃষ্টি হেফাজত করলে পুরস্কার বেশি না বুড়ো বয়সে?
নারীরা কোন বয়সে পর্দাবতী হলে বেশি পূণ্যবতী হবেন বলে মনে হয়?
তাফসীর নোটস
- কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কিছু বলা বা করা যাবে না
- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার উপর কোনো কথা নেই
- ইসলাম নিয়ে কথা বলার আগে অনেক হুঁশিয়ার থাকতে হবে
তাফসীর সূত্র
ইসমাঈল ইবনে কাছীর, তাফসীর ইবনে কাছীর। অনুবাদ: আখতার ফারূক। খণ্ড ১০। ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১৪।