ফেসবুক, ব্লগ, ওয়েবসাইট—অনলাইনে ক্যাচাল করার সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন মাধ্যম। কারও কোনো কথা পছন্দ হলো না, অমনি শুরু হয়ে গেল। কারও কোনো যুক্তি নিজের আবেগ-বিশ্বাসে হানা দিল, শুরু হলো পাল্টা হামলা। কারও প্রমাণ নিজের পূর্বধারণার পরিপন্থী, ব্যাস শুরু হলো ক্যাচাল।
অনলাইনে নিজের মত প্রকাশের সহজতার কারণে আজকাল চায়ের দোকান থেকে ক্যাচাল জায়গা করে নিয়েছে কিবোর্ডে। অথচ একটু সতর্ক হলে, মাথাটা ঠান্ডা রাখলে, যৌক্তিক উপায়ে আগালে এই ক্যাচালই উন্নীত হতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ মতপার্থক্যে। মানুষ সাধারণত কীভাবে ক্যাচাল করে সে ব্যাপারে প্রোগ্রামার, লেখক পল গ্রাহাম (পিএইচডি) তাঁর ওয়েবসাইটে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি মতপার্থক্যের সাতটি ধরন উল্লেখ করেছেন। এগুলোর প্রথম তিনটি ধরন নির্ঘাত ক্যাচালের আওতায় পড়বে। পরের দুটোকে “ভিন্নমত” হিসেবে ধরা যায়। আর বাকি দুটোকে আমার মতে শ্রদ্ধাপূর্ণ মতপার্থক্যের মধ্যে ফেলা যায়।
১. তকমা দেওয়া
“আপনি একটা অমুক”, “আপনি একটা তমুক”, “আপনি এই”, “আপনি সেই”—তকমার কোনো শেষ নেই। মানুষ যখন কারও মতকে কোনো দিক থেকেই মোকাবিলা করতে পারে না, সাধারণত তখনই বিরোধী পক্ষের গায়ে বিভিন্ন তকমা সেঁটে দেয়। ইসলামি জীবনব্যবস্থার শেষ নাবি মুহাম্মাদকে (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) তাঁর সময় থেকে শুরু করে আজও বিভিন্ন তকমা দেওয়া হচ্ছে। জাদুকর, কবি থেকে শুরু করে হাল আমলে তাঁর নাম বিকৃত করে বিভিন্ন তকমা দেওয়া হয়েছে। হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে নিজেদের দাবি করেন, তারাও হরহামেশাই অন্যদেরকে বিভিন্ন তকমায় “ভূষিত” করেন। দুঃখজনক। নিঃসন্দেহে এটা ভিন্নমত পোষণের সবচেয়ে নীচু ধরন।
২. ব্যক্তিগত আক্রমণক্যাচালের দ্বিতীয় ধরন হচ্ছে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা। এক্ষেত্রেও যখন মূল যুক্তি বা প্রমাণের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু দাঁড় করানো যায় না, তখন এই পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এটা তকমা দেওয়ার চেয়ে এক লেভেল উপরে হলেও এটা ক্যাচালেরই আরেকটি ধরন। এ ধরনের ক্যাচালের একটি উদাহরণ হচ্ছে কারও উদ্দেশ্যে এরকমটা বলা যে, “আপনি তো এমনটা বলবেনই কারণ আপনি তো অমুক, তমুক বা অমুক বিশ্বাস বা তমুক মতাদর্শের অনুসারী”।
কোনো মুসলিম যখন যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব, একত্ব, নাবি ও প্রত্যাদেশের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তখন তার সঙ্গে ক্যাচাল করার অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রথমে তাকে মুসলিম “তকমা” দেওয়া। এবং তারপর ব্যক্তিআক্রমণ করা: “আপনি মুসলিম, আপনি তো এমনটা বলবেনই”।
৩. বচনভঙ্গি বা লিখনশৈলীতে আক্রমণক্যাচাল করার অন্যতম আরেকটা কৌশল হচ্ছে মূল পয়েন্ট থেকে দূরে সরে গিয়ে পার্শ্ববিষয়ের উপর আলো ফেলে সেটা নিয়ে তর্ক করা। এক্ষেত্রে কারও বক্তব্য বা লেখনীর মূল যুক্তির বিরোধিতা করতে না পেরে ক্যাচালকারীরা বক্তার বা লেখকের বচনভঙ্গি ও লিখনশৈলীর নিয়ে কাইজ্জা করেন: “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তিনি ‘এভাবে’ কথাটা বলতে/লিখতে পারলেন।”
কথার বা লেখার কোথায় বক্তা/লেখক ভুল করেছেন সেটা না বলে পার্শ্ববিষয় নিয়ে ক্যাচাল করা ক্যাচালকারীদের অন্যতম প্রিয় বিষয়।
উপরের তিনটির সবই ক্যাচালের বিভিন্ন ধরন। সবগুলো ক্ষেত্রেই কী বলা হচ্ছে সেটা ভালো করে না-বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। কোনো সন্দেহ নেই, মানুষের অহংবোধ, আগে থেকে লালিত বিশ্বাস এক্ষেত্রে যৌক্তিক ও ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা থেকে বিরত রেখে তাকে ক্যাচালে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি এটা খুবই সহজ। যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে কারও মতের বিরোধিতা করতে হলে নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে অনেক সময় হয়তো তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর বা মত প্রদান করা সম্ভব না; বা অনেক সময় তা করা উচিৎও না। কারণ আবেগের বশে সেই মুহূর্তে আমরা এমন কোনো কথা বলে ফেলতে পারি, যেটা নিয়ে আমরা নিজেরাই হয়তো পরে আক্ষেপ করব। তাই ভেবেচিন্তে কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। তবে তৎক্ষণাৎ কিছু যদি বলতেই হয়—যদিও এতে মতপার্থক্য কেন সেটা স্পষ্ট হয় না— তাহলে ভিন্নমত প্রদর্শনের সেই ধরনকে পল গ্রাহাম নাম দিয়েছেন কনট্রাডিকশন বা বিরোধিতা হিসেবে।
৪. বিরোধিতা
পাল্টা তর্কের এটা সবচেয়ে নিচু ধরন। উপস্থাপতি মতের ক্ষেত্রে এক্ষেত্রে সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধিতা প্রকাশ করা হয়; যদিও পাল্টা যুক্তি-প্রমাণ থাকে অনুপস্থিত। এ ধরনের ভিন্নমত প্রকাশের উদাহরণ হতে পারে: “আমি আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে একমত নই (কোনো একটা কারণে, কিন্তু এই মুহূর্তে সেই কারণটা বলতে পারছি না।”
৫. পাল্টাযুক্তি
ভিন্নমত প্রকাশের এই পর্যায়ে প্রথমবার কোনো মতের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। কখনো কখনো হয়তো অগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে পাল্টাযুক্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় বক্তব্য-লেখনীর মূল বিষয়ের পরিবর্তে অন্য কোনো বিষয়ে পাল্টাযুক্তি দেওয়া হয়। তবে যা-ই হোক, এক্ষেত্রে অন্তত ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম কোনো পাল্টা যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়।
৬. খণ্ডন
এ পর্যায়ে এসে শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে কারও মতের বিরোধিতা করা হয়। কোনো মত কেন ভুল সেটা উপযুক্ত প্রমাণ ও যুক্তির সঙ্গে তুলে ধরা হয়। কাজটা সহজ নয়, তবে পাণ্ডিত্যপূর্ণ (Academic) মতপার্থক্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে এটা প্রথম ধাপ।
৭. মূলবিষয়ের খণ্ডণ
কারও সঙ্গে মতবিরোধ করার এটা সবচেয়ে উঁচু পর্যায়। এক্ষেত্রে শুধু পাল্টা যুক্তি-প্রমাণই উপস্থাপন করা হয় না, বরং কোনো মতের মূলদিকটি কেন ভুল সেটা শক্তিশালীভাবে দেখিয়ে দেওয়া হয়। যেমন: কেউ বলতে পারেন, লেখক অমুক অমুক কথা বলেছেন, কিন্তু তমুক তমুক কারণে এটা সঠিক নয়।
এভাবে আপনি যখন কোনো লেখা বা বক্তব্য পর্যালোচনা করে শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে ভিন্নমত দেবেন, তখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার মতের ধার বাড়বে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। মতপার্থক্য আজাইরা ক্যাচালে রূপ নেবে না।
তবে সেজন্য অবশ্য আপনাকে আগে অন্যের বক্তব্য ভালোভাবে বুঝতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় লেখক লিখলেন এক জিনিস, কিন্তু আমাদের পূর্বধারণা, (prejudice), অসচেতনতা কিংবা পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে বুঝলাম আরেক জিনিস। ফলে আমাদের প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে সঠিক হবে না। আমাদের ভিন্নমত মূল বিষয়কে পাশে ফেলে তুচ্ছ বা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরবে। কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন বিষয় নিয়ে ক্যাচাল শুরু হবে যার সঙ্গে মূল লেখার কোনো সম্পর্কই নেই।
কোনো মত কেন ভুল বা সঠিক শুধু সেটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। আপনাকে বলতে পারতে হবে যে, সেটা কেন সঠিক বা ভুল। মর্টিমার অ্যাডলার তাঁর “হাউ টু রিড অ্যা বুক”-এ লেখক কী কী ক্ষেত্রে ভুল হতে পারেন সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন। এটা হতে পারে:
১. কোনো বিষয়ে লেখকের জ্ঞানের ঘাটতি আছে। সেক্ষেত্রে আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে কোথায় তার ঘাটতি।
২. লেখক কোনো বিষয়ে হয়তো ভুল জানেন। সেক্ষেত্রে আমাকে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে।
৩. লেখকের যুক্তি অযৌক্তিক বা ভিত্তিহীন। সেক্ষেত্রে আমি যখন পাল্টাযুক্তি দেব তখন খেয়াল রাখতে হবে আমার যুক্তি যেন অযৌক্তিক বা ভিত্তিহীন না-হয়।
যদি উপরের কোনোটিই আমি করতে না-পারি তাহলে লেখকের সঙ্গে একমত না-হওয়া ছাড়া উপায় নেই। যদি তা না করি, তাহলে বুঝতে হবে আমার আবেগ বা পক্ষপাতিত্ব এক্ষেত্রে যুক্তি-প্রমাণের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।
আমার বিশ্বাস উপরের আলোচনায় অনেকেই তার নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। হয়তো পড়তে পড়তে আনমনে বলে উঠেছেন, “আরে, আমি তো এটাই করি।” এই উপলব্ধি যদি এসে থাকে, তাহলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সময়নষ্টকারী আজাইরা ক্যাচাল এড়িয়ে শ্রদ্ধাপূর্ণ মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে আপনি প্রথম ধাপ নিয়েছেন। এখন সেই যাত্রা অব্যাহত রাখুন। আপনার জানার পরিধিকে বড় করুন। মনটাকে প্রশস্ত করুন। অনলাইনে সবসময় আমাদেরকে তাৎক্ষণিক মতামত জানাতে হবে এমন কোনো বিধি নেই। সময় নিন। নিজের যুক্তিগুলোকে গুছান। আরও জানুন, পড়ুন। ভিন্নমত থাকলে এরপর শ্রদ্ধাপূর্ণ উপায়ে সেটা তুলে ধরুন। লেখককে সহযোগিতা করুন। আসুন ক্যাচাল করে পরিবেশ গরম করে বা সাময়িক তৃপ্তির ঢেঁকুর না-তুলে পরস্পরের প্রতি সম্মানজনক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব গ্রহণ করি।
No comments:
Post a Comment
আপনার সুচিন্তিত ও গঠনমূলক মতামতের জন্য ধন্যবাদ।