মূল: ইয়াসমিন মোগাহেদ
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ শামিল হয়েছে বহু অভিযাত্রায়। কিন্তু একটি অভিযাত্রায় কেউ কখনো যেতে পারেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ শামিল হয়েছে বহু অভিযাত্রায়। কিন্তু একটি অভিযাত্রায় কেউ কখনো যেতে পারেনি।
কেউ না—শুধু একজন বাদে।
যে-অভিযাত্রায় সেই একজন গিয়েছিলেন এমন এক বাহনে চড়ে যে-বাহনে
কোনো মানুষ চড়েনি কোনোদিন; এমন এক পথে যে-পথ কোনো আত্মা দেখেনি কখনো। সেটা এমন এক
জায়গায় যেখানে এর আগে কোনো সৃষ্টিরই পদচিহ্ন পড়েনি। সেই যাত্রা ছিল ঐশী সত্ত্বার
সাথে সাক্ষাতের যাত্রা। সেটা ছিল সর্বোচ্চ মহাকাশের পানে আল্লাহর নাবি মুহাম্মাদ
সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাত্রা।
সেই অভিযাত্রায় আল্লাহ তাঁর প্রিয় নাবিকে সপ্তম মহাকাশে
তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন—এমন এক জায়গায় যেখানে ফেরেশতা জিব্রিলেরও প্রবেশাধিকার ছিল
না। পৃথিবীতে নাবির মিশনে প্রতিটা আদেশ-নিষেধ, বিধিবিধান ফেরেশতা জিব্রিলের
মাধ্যমেই পাঠানো হতো। কিন্তু একটি বিধান ছিল যেটা তাঁর মাধ্যমে পাঠানো হয়নি।
বিধানটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ফেরেশতা জিব্রিলকে পাঠানোর পরিবর্তে আল্লাহ
তাঁর প্রিয় নাবি সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর কাছেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
সেই বিধানটা ছিল সলাত বা নামাজ। নাবি সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়া সাল্লামকে প্রথম যখন সলাতের আদেশ দেওয়া হয় তখন এটা ছিল দিনে পঞ্চাশবার। আল্লাহর
কাছে বিধানটি সহজ করে দেওয়ার আবেদন জানালে এটিকে কমিয়ে দিনে পাঁচবার করে দেওয়া হয়।
তবে অটুট রাখা হয় পঞ্চাশবার পড়ার সওয়াব।
ঘটনাটার উপর আলোকপাত করে ইসলামিক বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন যে,
পঞ্চাশ থেকে পাঁচে কমানোর এই ঘটনা সুচিন্তিতভাবেই করা হয়েছে। এর নেপথ্যে উদ্দেশ্য
ছিল আমাদের জীবনে সলাত যে কত গুরুত্বের দাবি রাখে সেটা শেখানো। একটু ভেবে দেখুন:
সারাদিন আপনি পঞ্চাশবার সলাত পড়ছেন; সেক্ষেত্রে সলাত বাদে আপনি কি আর কিছু করতে
পারতেন? না। এটাই মূল কথা। আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য এর
চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারত? যেন বলা হচ্ছে সলাতই আমাদের আসল জীবন; বাকি আর যা
কিছু নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি সেগুলো কেবলই দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গিক ঘটনা।
কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবন যেন এর পুরোই বিপরীত। সলাতকে
কোনোমতে আমাদের ব্যস্ত জীবনের ভেতর ঠাই দেওয়া হয়। সলাতকে ঘিরে আমাদের ‘জীবন’
আবর্তিত হয় না। বরং আমাদের জীবনকে ঘিরে সলাত আবর্তিত হয়। ক্লাসে থাকলে সলাত হলো
সর্বশেষ চিন্তা। শপিংয়ে বের হলে আড়ংয়ের মূল্যছাড় আমাদের কাছে অধিক জরুরি। কিছু
একটা অবশ্যই খুব ভুল হচ্ছে যখন আমরা আমাদের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্যকে পাশে ফেলে
রেখে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা দেখায় মশগুল হয়ে থাকি।
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তারা অন্তত সলাতটা পড়ার চেষ্টা
করেন। কিন্তু এমনও মানুষ আছেন যারা কেবল জীবনের উদ্দেশ্যটাকে ফেলেই রাখেন না, বরং
জীবন থেকেই একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। সলাত ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা যে
ব্যাপারটা বুঝতে চাই না সেটা হচ্ছে: কোনো ইসলামি বিশেষজ্ঞই এমন মত পোষণ করেননি যে,
যিনা বা ব্যাভিচার করলে কেউ অবিশ্বাসী-কাফির হয়ে যায়। কোনো বিশেষজ্ঞই এমন মত পোষণ
করেননি যে, চুরি করলে, মদপান করলে কিংবা নেশাখোর হলে কেউ অবিশ্বাসী হয়ে যায়। কোনো
বিশেষজ্ঞই এমন কথা বলেননি যে হত্যা করলে কেউ অমুসলিম হয়ে যায়। কিন্তু সলাতের
ব্যাপারে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, যে মানুষ সলাত ছেড়ে দেয় সে আর মুসলিম থাকে
না। একটি বিশুদ্ধ হ়াদীস়ের ভিত্তিতেই তারা এ কথা বলেছেন: “আমাদের আর ওদের মধ্যে
অঙ্গীকার হচ্ছে সলাত। কাজেই যে এই সলাত ছেড়ে দেয়, সে অবিশ্বাসী।” [আহমাদ]
ভেবে দেখুন একটা অপরাধ কতটা মারাত্মক হলে নাবি সল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কড়া কথা বলতে পারেন। এক মুহূর্তের জন্য একটু
ভেবে দেখুন, কী ভুল ছিল শয়তানের। সে কিন্তু আল্লাহকে
বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানায়নি। সে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কেবল একটিমাত্র সিজদাহ
করতে। কেবল একটি। একবার ভেবে দেখেছেন কি, সারাদিন কত শত
সিজদাহকে আমরা অস্বীকার করে চলেছি।
কখনো চিন্তা করে দেখেছেন কি এই অস্বীকৃতি কতটা ভয়াবহ
পরিণাম নিয়ে আসতে পারে? তা সত্ত্বেও সলাতের ব্যাপারটা কি হালকাভাবেই না বিবেচনা করি
আমরা। বিচার দিনে প্রথম যে বিষয়ে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সেটা হচ্ছে সলাত। আর
এটাই কিনা আমাদের বিবেচনায় আসে সবার শেষে। নাবি সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বিচার দিনে মানুষের কর্মগুলোর মধ্যে প্রথম যে কাজের বিষয়ে
বিচার করা হবে সেটা হচ্ছে সলাত। এটা যদি ঠিক থাকে তাহলে সে সফল হবে। কল্যাণ লাভ
করবে। আর এটায় যদি ত্রুটি থাকে তাহলে সে হবে ব্যর্থ, ক্ষতিগ্রস্থ।” [তিরমিযি]
সেদিন জান্নাতের অধিবাসীরা জাহান্নামের বাসিন্দাদের
জিজ্ঞেস করবে কেন জাহান্নামে তাদের ঠাই হয়েছে। তাদের প্রথম উত্তর কী হবে সে
ব্যাপারে ক়ুর’আন বলছে, “কোন কাজ তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে এল? তারা বলবে, ‘আমরা
সলাত পড়তাম না।’” [আল-ক়িয়ামাহ, ৭৪:৪২-৪৩]
আমরা কি তাদের মতো হব সেদিন যারা বলবে “আমরা সলাত পড়তাম
না, কিংবা আমরা সময়মতো সলাত পড়তাম না, সলাতকে আমাদের জীবনে কোনো গুরুত্বই দিতাম না?”
ক্লাসে বা কাজে থাকা অবস্থায় কিংবা ফাজ্রের সময় ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের যদি
বাথরুমে যেতে হয়, তাহলে তো ঠিকই আমরা সেজন্য সময় করে নিই। আসলে এই প্রশ্নটাই তো
অযৌক্তিক। বাথরুমে না যেয়ে ক্লাস করব, কাজ করব, কিংবা ঘুমিয়ে থাকব সেরকম কিছু
চিন্তাই করি না আমরা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাতেও যদি আমরা থাকি থাকি
তবু আমাদের যখন বেগ চাপে তখন আমরা যাবোই। কেন? কারণ, না গেলে আমাদের যে লজ্জাজনক
পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সেটা ভাবলেই না-যাওয়ার চিন্তা এক মুহূর্তে উবে যায়।
অনেক মানুষ আছেন যারা বলেন কার্যক্ষেত্রে, স্কুলে কিংবা
বাইরে থাকলে তারা সলাত পড়ার সময় পান না। বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়লেও কি তারা একই
কথা বলবেন? তারা কি বাথরুমে না যেয়ে ডায়পার পড়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেন? ফাজ্রের
সময় বেগ চাপলে বাথরুমে না-যেয়ে কজন এই সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা আজ বিছানা ভেজাবেন? বাস্তবতা
হচ্ছে বাথরুমে যাওয়ার জন্য আমরা ঠিকই বিছানা ছাড়ব, ক্লাস থেকে বের হব কিংবা কাজ
থামিয়ে দেব; কিন্তু যত যাই হোক সলাত পড়ব না।
হাস্যকর শোনালেও সত্য এটাই যে, আত্মার খোরাকের চেয়ে আমরা
শারীরিক প্রয়োজনকেই বেশি প্রাধান্য দিই। আমরা খাবার খাই; কারণ না-খেলে মারা যাব।
কিন্তু আমাদের অনেকেই তাদের আত্মাকে অভুক্ত রাখেন। তারা ভুলে যান আমরা যদি সলাত
না-পড়ি তাহলে আমাদের আত্মা মারা যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যে-শরীরের প্রতি আমরা
এত নজর দিই সেটা ক্ষণস্থায়ী, আর যে-আত্মার চাহিদাকে আমরা উপেক্ষা করি সেটাই
চিরস্থায়ী।
মাশা আল্লাহ। দারুণ অনুবাদ।
ReplyDelete